Saturday 24 May, 2008

র‌্যাম্বোর প্রেম


এই পৃথিবীতে দু' শ্রেণীর লোক আছে। এক - যারা ফুলশয্যায় নববধ‌ূর সঙ্গে সহবাসে তার অনিচ্ছা প্রকাশে স্তিমিত ‌হয়ে পড়েন এবং জীবনভোর তার থেকে মুক্তি পান না। এবং দুই - যারা স্ত্রীর ও কি করছো ছি ছি শুনে বীরদর্পে বলেন বেশ করছি ‌হি হি। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকের মধ্যে পড়েন আমাদের পাড়ার রা‌হুল বোস - পাড়ার ছেলেরা যাকে আড়ালে রাউল-সর্দার বলে ভেঙচায়। তবে তাঁকে নয় - তাঁর এক মাত্র পুত্র র‌্যাম্বোকে নিয়েই আজকে আমাদের গল্প।

র‌্যাম্বো প্রেমে পড়েছে। তা - সেটা কি এমন আশ্চর্যের কথা? কবি তো বলেইছেন প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। শুধু জাল গুটিয়ে নিতেই যা দেরি। দ্বিতীয় কথাটি অবশ্য কবিবর লিখতে ভুলে গেছিলেন। তা যাই হোক! আপনি আপনার শালির প্রেমে ‌হড়কাতে পারেন, আপনার মেয়ে coaching class-এ বাদল sir-এর সঙ্গে, বউদি office-এর boss-কে নে' চুপু-চুপু - আর র‌্যাম্বোবাবু প্রেমে পড়লেই সেটা অন্যায়? এ কিন্তু ভারি অন্যায় আপনাদের! IPC-র কোথাও কিন্তু লেখা নেই যে class 5-এর ছেলেরা পাগল-প্রেমিক ‌হতে পারে না।

র‌্যাম্বোর ক্ষেত্রে কিন্তু পূর্বেল্লিখিত ফাঁদটি যে সে ফাঁদ ছিল না - ছিল একেবারে booby trap। কয়েক মাস আগের কথা ‌হবে। school থেকে ফিরে সে একমনে aeroplane চালাচ্ছিল computer-এ। খুব বিরক্ত ‌হচ্ছিল সে। যতো বার plane ওড়াতে চাই বারে বারে যায় ভেঙ্গে। হঠাৎ দিদির ঘরে গলার আওয়াজ পেয়ে দেখে একটা মেয়ে তার দিদির সঙ্গে গল্প করছে। সেই প্রথম চারি চক্ষুর মিলন। তার college-এ পড়া দিদির বান্ধবী শ্রেয়সী সেদিন থেকেই র‌্যাম্বোর প্রেয়সী! যাকে বলে একেবারে প্রথম দর্শনেই প্রেম।

রূপকথায় পড়া কেশবতী কন্যার চেয়েও মেঘ-কালো তার খোলা চুল - তা থেকে কি সুন্দর মিষ্টি ‌গন্ধ বেরোয়। মেয়েটাকে খুব ভালো লেগে গেছে র‌্যাম্বোর। দূর থেকে যখন ‌হেঁটে হেঁটে আসে তখন মনে হয় যেন Cindy Crawford catwalk করতে করতে তাদের বাড়িতে আসছে। চোখ তার - মুখ তার - Picasso-র তুলি টানে আঁকা। ‌হাসলে পরে ঠোঁটের কোণে নীলচে ব্যথার আভাস। ক'দিন আগে যখন ‌হলদে পাড় শাড়ি পড়ে বাড়ির পুজোয় অঞ্জলী দিতে এসেছিল - তখন তাকে সরস্বতী ঠাকুরের চেয়েও বেশি রূপসী লেগেছিল র‌্যাম্বোর। আর বিভৎস নাচে। র‌্যাম্বো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে এক দিন। It's the time to disco গানটার সঙ্গে এতো সুন্দর কোমর দোলায় না - উফফফফফ! এ মেয়ে রামধনুর ওপারের দেশের মেয়ে।

র‌্যাম্বো ঠিক করে ফেলেছে। শ্রেয়সীকে সে বউ করবে। তারপরে তাকে নিয়ে honeymoon-এ যাবে - না - কোথায় যাবে সেটা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। এই ব্যাপারটাতেই তার মনে ইট্টুসখানি খটকা আছে। সবাই বলে honeymoon-এ অমুক জা’গায় গিয়েছিলাম তমুক জা’গায় গিয়েছিলাম। বাড়িতে বোধহয় honeymoon করা সম্ভব নয়। আর honeymoon-এ ঠিক কি কি করতে ‌হয় সে সম্পর্কেও তার মনে খুব একটা স্পষ্ট ধারনা নেই। honeymoon মানে তো বউয়ের সঙ্গে বেড়ু-বেড়ু করতে যাওয়া। এ’ পর্যন্ত যতগুলো cinema দেখেছে র‌্যাম্বো সবেতেই খালি এক scene দেখায়। বর আর বউ একসঙ্গে খাটে বসে থাকে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে মেয়েটার বোধ‌হয় খিদে পেয়ে যায়। তখন ছেলেটা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। এই তো আরেকটু পরেই সকাল ‌হয়ে যাবে। তখন আমরা ডিমসেদ্ধ-দুধ-cornflakes খাবো। তারপরে যখন তারা ঘুমু-ঘুমু করছে - ব্যাস! ঠিক সেই সময় ফচাৎ করে আলো নিভে যায়। movie-ওয়ালাদের ওপরে খুউব রাগ ‌‌হয়ে যায় র‌্যাম্বোর। আর দু’ minute দেরি করে আলোটা নেভালে কি এমন ক্ষতি ‌হতো? এখন সে কাকে জিজ্ঞেশ করবে - মাকে? না - মাকে জিজ্ঞেশ করে কোনো লাভ নেই - মা সব কথাতেই না বলে। এক দিন মাকে জিজ্ঞেশ করেছিল - moods কি? মা তখন খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিল - জানিনা। শেষ পর্যন্ত তার বন্ধু অভিষেককে জিজ্ঞেশ করতে সে অনেক ভেবেচিন্তে বলেছিল, ওগুলো মনে ‌হয় assorted logenzes, তার দাদার বইয়ের তাকে এক দিন রঙচঙে একটা packet দেখে ‌হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে সবে - এমন সময় কোত্থেকে দাদা ছুটে এসে তার কানটা খুব জোরে মুলে দিয়ে বললো আমার chocolate-এ ‌‌‌‌হাত দিয়েছিস কেন?

অভিষেকের বুদ্ধির ওপরে অবশ্য র‌্যাম্বোর খুব-একটা ভরসা নেই। ঠিক করে যদি একটা জিনিস বুঝিয়ে বলতে পারে। বলে জানিস, packet-টার ওপরে একটা ‌মেয়ের ছবি আঁকা, ball দু’টো না ইয়াব্বড়ো! কি’রম chocolate রে বাবা?

র‌্যাম্বো ঠিক করে ফেলেছে honeymoon-এ যাওয়ার আগে বাবাকেই সে জিজ্ঞেশ করবে। বেড়ু-বেড়ুকে honeymoon-পদবাচ্য করতে গেলে কি কি করতে ‌হয়। বাবা নিশ্চয়ই জানবে। বাবার ঘরে অ্যাত্তো মোটা মোটা সব বই। আর বাবাও যদি না জানে তা‌‌’লে শেষমেষ পাড়ার ডাক্তারখানার রাজুদাকেই জিজ্ঞেশ করা যাবে। রাজুদার সঙ্গে অবশ্য খুব একটা দোস্তি নেই র‌্যাম্বোর। কয়েক বছর আগে যখন খুব শক্ত একটা অসুখ করেছিল তার, কিছুতেই ধরা পড়ছিল না, তখন ডাক্তারকাকু রাজুদাকে কি সব যেন বললো। তার পরের দিন খুব সক্কাল সক্কাল রাজুদা বাড়িতে এসে ‌হাজির। র‌্যাম্বোকে দেখে বিচ্ছিরিভাবে ‌হেসে ভালুকের মতো নাক চুলকুতে চুলকুতে বললো - এই ন্যাও শিশি, করে ফ্যালো হিশি।

কিন্ত এতো দিন ‌হয়ে গেলো - কাজের কাজটাই ‌হচ্ছে না র‌্যাম্বোর। মেয়েটা তার সঙ্গে সব সময় ‌হেসে ‌হেসে কথা বলে। অ্যাই তোর নাম কি রে? কোন class-এ পড়িস? কোন school? তবে প্রণয়িনীর মুখে তুই-তোকারি শুনে খুব একটা ভরসা পায়নি র‌্যাম্বো তার ‌হৃদয়ের কথা জানাতে। কিন্তু জানাতে তাকে তো ‌হবেই। রিতিক প্রেমের জন্যে এতো কিছু করছে, লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে - আর সে এক বার ইলু বলতে পারবে না? অভিষেক তাকে গল্প করেছে এক ছোটি সি ল্যভ স্টোরিতে তো একটা ছেলে তার চে’ বড়ো একটা মেয়েকে propose করেছিল। হ্যাঁ - বিয়ের কথাটা বলার আগে তাকে ilu বলতেই হবে - না ‌হলে মেয়েটা ভাববে ছেলেটা কি ‌হেঙলু রে বাবা।

এ’ সব কথা ভাবতে ভাবতে র‌্যাম্বোর মন উৎফুল্ল ‌হয়ে ওঠে। আনন্দের চোটে সে লাফাতে আরম্ভ করে - হ্যাঁ - ঘাবড়ে যাবেন না। পরশপাথর পড়েননি? প্রেমে পড়লে লোকের মনে পুলক জাগে। তখন তার শরীরের mechanism আরো energetic‌ হয়ে ওঠে।

পাজি ছেলে! দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে লাফাচ্ছো? মা ঘরে ঢুকে র‌্যাম্বোকে ডেকে খুব করে বকে দেন। তা - মাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি তো আর বিজ্ঞান-টিজ্ঞান পড়েননি। তিনি জানবেন কি করে প্রেমে পড়লে মানুষের মস্তিষ্কে endorphin নামে এক ধরণের পদার্থ তয়ের ‌হয়, যার রাসায়নিক গঠন একদম morphin-এর মতোই, আর এর জন্যেই লোকে মাল-খাওয়া public-এর মতো আচরণ করে - এর জন্যেই র‌্যাম্বোর এতো নাচন-কোঁদন।

মা চলে যাওয়ার পরে র‌্যাম্বো ফোঁৎ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শ্রেয়সী তুমি আমার - ‌হ্যাঁ -শুধু আমার।

কথায় বলে স্বয়ং ভাগ্যদেবী নাকি উদ্যোগী পুরুষের সহায় হন। র‌্যাম্বোর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না একদিন।

সেদিন - শনিবার বিকেলবেলা - দিদি library-তে গেছে বই আনবে বলে। calling বেলের শব্দ শুনে র‌্যাম্বো দরজা খুলে দেখে শ্রেয়সী - তার হৃদয়েশ্বরী।

র‌্যাম্বোর বুক দুরুদুরু করে ওঠে। কতো রজনীর পরে বঁধু আজি এসেছে লগন। মনের ভাব গোপন করে জানায় যে দিদি এক্ষুণি ফিরবে। তোমার সঙ্গে আমার একটা serious কথা আছে। শ্রেয়সীর পাশে সেও sofa-তে ধপ করে বসে পড়ে। তার মুখের দিকে চেয়ে আরো serious স্বরে বলে র‌্যাম্বো - I love you। আমায় বিয়ে করবে?

শ্রেয়সীকে কোনো কথা না বলতে দেখে র‌্যাম্বো মনে মনে একটু ‌হাসে। এটা সে জানে। মেয়েরা যখন চুপ করে থাকে তখন তার মানে ‌‌হ্যাঁ। আরো উৎসাহিত হয়ে সে যে কতো বড়ো পাগল-প্রেমিক তা প্রমাণ করার জন্যে শ্রেয়সীর গালে চপাৎ করে একটা চুমু খায়।

অসভ্য বাঁদর ছেলে! শ্রেয়সী র‌্যাম্বোর কান দু’টো খুব জোরে মুচড়ে দেয়। এখনো pant-এর chain আটকাতে মনে থাকে না এদিকে মুখে যতো পাকা পাকা কথা। দাঁড়া - এক্ষুণি তোর দিদিকে বলছি।

তার প্রাণেশ্বরীর মুখের ভাব ক্রমশ: ‌হিংস্র থেকে ‌হিংস্রতর ‌হতে থাকায় সেখানে থাকাটা আর সমীচিন বলে মনে করে না র‌্যাম্বো। সুট করে সরে পড়ে সে।

র‌্যাম্বোর প্রেমপর্বের এখানেই ইতি। প্রেমিকার ‌‌হাতের কানমলা খেয়ে আর ‌pant-এর chain আটকানো নিয়ে এতো বড়ো একটা অপবাদ দেওয়াতে তার জীবনে ভয়ঙ্কর বৈরাগ্য এসে গেছে। এখন সে প্রত্যেক শনিবার বিকেলে মন দিয়ে profit & loss-এর অঙ্ক করে। শ্রেয়সী অবশ্য আগের মতোই তাদের বাড়িতে যাতায়াত করে।





৯৭ - ০০

No comments: