Monday 2 July, 2007

সেদিনও বিস্ময়-বালিকা


সেদিনও বিস্ময়-বালিকা বিরক্ত
কে তুই? চুপ ছোঁড়া!
অর্ধরেচিত আদেখলামি করে ফেলে
মরমে মরে ছিল বেনামী অনুরক্ত।

অন্তরঙ্গ যন্ত্রণা, তবুও উলঙ্গ শবর-শিশু
প্রাণপণে ভাবে ভানে, পরিকল্পিত কথার তানে
করেছিল গোপন, মন যে মোগাদিসু
প্রণয়-নিপুণ নগরেতে করে বসবাস -
অগ্রজার আঁচল টেনে, কারণে কি অকারণে
নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার হয়নি অভ্যাস।

আঁধার নামলে আনাচে কানাচে
প্রথা মেনে আঁখি-সঙ্কেতে,
বড়ো-ছোটো মেজো-সেজো পরীরা দেয় ডাক
আসুন না - দু' দন্ড প্রেম করা যাক।

হাসতে হাসতে তথাগতর সীসা-আশীর্বাদ
বাম হস্তে শষ্য ধারন - রচেন শিল্পিত বুনিয়াদ,
একলা ক্যাবলা দৌড়ে পালায় চার্নক-কার্বালা
তবুও পিছু ছাড়ে না কিছু মার্কারি-স্মৃতি-আলেয়া।

Friday 29 June, 2007

পুংকিসোনা


মামা বলেন - পড়তে বসো,
ওকি - তোমার জামায় কেন দাগ?
প্রফিট-লসের অংকে ভুল,
তাই - কাকাও করেন রাগ।
বোন ভাবেন বিয়ের কথা,
দিদির বর আসবে - সেতো দারুণ মজা!
ভাই ভাবেন পিংকিরাণী...
নাকি পুংকিসোনা, কোনটা সাজা সোজা?

চয়নিকা আমার সাথে ইশকুলে পড়ত


আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়তাম। অবশ্য চয়নিকার সংগে আমার বন্ধুতা খুব ছোটোবেলা থেকেই। একই পাড়ায় থাকি। এক ইশকুলে পড়ি। আমার মনে আছে, যখন আমরা প্রাইমারিতে পড়তাম, ও ছুট্টে এসে আমার কাছে আবদার করত - দেখি দেখি তোর হিসি দেখি।

ছেলেদের হিসি দেখে না চয়ি। অনেক কষ্টে আমি ওকে বোঝাতাম। ওর সম্পর্কে অনেক কথাই মনে পড়ছে এখন লিখতে লিখতে। ওর চোখ - সেই দৃষ্টিতে জলংগির জলে ডুব সাঁতারের অভিজ্ঞতা খুঁজে পেয়েছিলাম। আর কমলালেবুর কোয়ার মতো নিঃসংগ ব্যথার নীলাভ আবেদনে ঋদ্ধ ঠোঁট দুখানি - কতো কথাই না বলত আমার সংগে সে দুটি দিয়ে।

কাকিমার খুব চিন্তা ছিল ওনার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েরা হবে শান্তশিষ্ট - এই ছিল তাঁর মত। আর চয়ি ছিল ঠিক তার উল্টো। কোথায় কোন কুকুরছানা কুঁইকুঁই করছে দেখে তাকে তুলে এনে আদরযত্ন করা, কোন পাখির ডানা ভেংগে গেছে বলে তাকে ঘরে নিয়ে আসা, এ সবই ছিল চয়ির খুব প্রিয় কাজ - আর তাই দেখে রাগ হয়ে যেত কাকিমার।

রাগের চোটে আমার মাকে একেক সময় বলেই ফেলতেন - আমার মেয়েটাকে নেন না দিদি আপনার ছেলের জন্যে। মানে আমার জন্যে - আমার পেশা দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন পড়াশোনায় আমি কোনোদিনই খুব একটা খারাপ ছিলাম না।

তাই শুনে চয়ির বাবা আর আমার বাবা দুজনেই প্রাণ খুলে হেসে উঠেছিলেন।

চয়ির কথা এই প্রথম আমি লিখছি সাইবারদুনিয়ায়। যে কথা এতদিন সযতনে রেখে দিয়েছিলাম নিজের মনের গোপণতম কোণে - আজ তাকে প্রকাশের আলোয় আনছি একটাই কারণে।

কিছু কিছু কথা ইংরিজিতে লিখতে নেই...লিখতে ইচ্ছে করে না...তাই এতদিন লিখিনি।

বাকিটা কালকে।





অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন ব্যাপারটা।

চয়নিকার কথা একদম লিখতে পারিনি - যদিও চেষ্টা করেছি খুব।

করে ডাকলাম...লক্ষীসোনা আমার...এসো প্লিজ।

না - কি করে আসবে? বড়ো অভিমানী যে মেয়েটা।

একটু...একটু না...বেশ ভালোরকমই দুষ্টু ।

কষ্ট দিয়ে ও কি যে মজা পায় তা কে জানে।

আবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে - তাই ও এসেছে।

দেখতে পাচ্ছেন কেমনটি মুচকি মুচকি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে? আবার বলছে - কেমন জব্দ!





আমাদের শহরে বেশ কয়েকটা লেক আছে। সেরকমই একটা লেক-নজদিক পাড়ায় আমরা থাকতুম। রোজ বিকেলে খেলা করতে যেতুম সেই সরোবরে - জায়গাটা আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় বলেই ইচ্ছে করে তার নামটি নিচ্ছিনে।

এক অচেনা শরতের শেষ বিকেলের কনে-দেখানো রাঙা আলোয় দেখেছিলুম ওকে, একটি একটি করে মাটিতে পড়ে থাকা সমস্ত ফুলগুলিকে কুড়িয়ে নিতে লেকের বুক থেকে, সেসব নাম-না-জানা বুনো উদ্ভিদের জৈবীঘ্রাণের কেউ কখনো খোঁজ রাখেনি।

খোঁজ রাখিনি আমিও - বয়োসন্ধির এক কিশোরের।

যে অনেক অবাক বিস্ময়ে আর বেশ কিছুটা পাপবোধ নিয়ে তাকিয়েছিল সেই কিশোরীর দিকে, দেখেছিল তার স্কুল-য়্যুনিফর্মের অসাবধানী অবগুণ্ঠন ভেদ করে আচমকা বেরিয়ে আসা ঊরুসন্ধির ঈষত রহস্যাভাসে অন্তর্লীন আহ্বানখানি, শুক্রাণু থেকে সন্তানধারণের এক ভাবিকালীন কোলাজ।

কিন্তু এসব অধ্যায় তো অনেকেরই জীবনে এসে থাকে - তাই নিয়ে ব্লগ লেখার কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আছে এসব কথার প্রকাশে নয় - এদের সাহায্যে কালহরণের।

আসল যে কথাটা বলব বলে এই লেখায় হাত দিয়েছিলাম, যা আপনাদের না জানালে ঋনীর যণ্ত্রণা নিয়েই হয়ত চলে যেতে হবে কোনো একদিন এই পৃথিবী থেকে, যার অস্তিত্বের অংগীকার আমার কাছে খুবই কষ্টের - সেই রক্তাক্ত স্বীকারোক্তির সহবাসে।





কয়েক মাস পরের কথা বলছি। সে সময় শহরে একটা খুব বিচ্ছিরি ধরণের ভাইরাল-জ্বর এসেছিল। আমাকেও ধরল। দিনে চার-ছটা ট্যাবলেট খেয়েও জ্বর কিছুতেই আর দুইয়ের নিচে নামেনা। বাবা-মা চিন্তিতমুখে ডাক্তারের কাছে ছুটলেন - হয়তো নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হতে পারে।

আমি একা একা চুপচাপ ঘরে শুয়ে কাজের লোকের রান্নার হাতাখুন্তির টুংটাং শুনছি। হঠাত বেলের শব্দে দেখি চয়ি ঘরে ঢুকছে।

তুই স্কুলে যাসনি?

ও আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল -

তুই ভালো হয়ে যাবি।

জ্বরের ঘোর তো ছিলই, তবু তার মাঝেই অনুভব করলাম ঘুঘুপাখির মতো ওর অর্ধ-তরল বুকদুটিতে আমার মুখ ডুবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, নিজেরই অজান্তে হাত দুটি সেঁকা হয়ে যাচ্ছে তার নিতম্বের ওমে।

নারী আজ মধ্যযামিনী, রক্তমাংস-স্বেদক্লেদের মহোল্লাসের মাঝে মানবী দেবী হয়ে উঠেছেন, কুমারিতণ্ত্রে যেরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর।

পীনস্তনী, পদ্মনাভি, রক্তাভ যোনি - সমস্ত কিছু দিয়ে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর অভয়দান, কোনো ভয় নেই তোর, ভালো হয়ে যাবি।

এই কি মায়া - নাকি এতোদিন ধরে যা দেখে এসেছি তাই ছিল মনের ভ্রম?

ঘোর কি তবে সত্যিই কাটল এতোদিনে - মেইট্রিক্সের নিওর মতো?

কোনটা চোখের ভুল - কোনটা?

ভয়ে আমি চোখ বুজে ফেলেছিলাম।

এর পরে ঠিক কি হয়েছিল তা জানিনা। চোখ খুলে দেখি মা-বাবা মাথার কাছে বসে আছেন।





ঠিক সে রাতেই আমার জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তার পরও বেশ কিছুদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল ডাক্তারের কড়া নির্দেশে।

কারো বারণ না শুনে চয়নিকাদের বাড়ি গেলাম সেই দুর্বল শরীর নিয়েই।

ছোট্টো একটা খবর আমার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল সেখানে।





মাত্র দুদিনের জ্বরে চয়নিকা আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।





যখন আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি, ঠিক তখনই চয়ি শয্যাশায়ী ছিল, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই কেউ আমায় খবরটা জানায়নি।





চয়ি - তুমি ছিলে আমার নিয়ম-ভাঙার-নিয়ম, আমার ফ্র্যাক্টাল-সুখস্বপ্ন, আমারই কেয়স-লজিক। আজ তুমি আমার ব্যাধি... আমার ভালোবাসা নিয়ে এমন এক জায়গায় চলে গেছো...যেখানে সব প্রশ্ন গেছে থেমে।

তবুও শেষ একটা প্রশ্ন তোমায় আমি করতে চাই।





এতো অভিমান করে চলে যেতে আছে কখনো?

Thursday 28 June, 2007

আঁধারলোকের ইতিবৃত্ত


রোজ রোজ ছলনার ছায়াপথ হাঁটা
ঘুম চোখে বিষমাখা আমিটাকে দেখা।
বৃষ্টি-পিছল আল, ছড়া-হাঁটু সম্বল,
ঘরহারা পথ খুঁজে ফেরে
সেই তুলসী-প্রদীপ, পার্থিব আলোবাসা, আর কি ডাকিবে অপূর্ব আব্দারে?
করুণা-অধর, মহাপ্রাণ তণ্ত্রপিতা, নিয়ণ্ত্রিত শ্বাস
কলঙ্কিত আনন্দের কৃষ্ণ-বাস্তব সহবাস।
চড় মেরে চুম্বন, সুন্দর, শালীন
চিরকৃতজ্ঞতায়, শুধবো না কোনোদিন, রেখাগাণিতিক সভ্যতারই অনুপম ঋণ।
এই প্রতারক করেই আশ মিটিয়ে অঞ্জলি-ইয়ুথ্যানাসিয়া
দীপক রাগে গুঞ্জে যাবে অভিমানী নীহারিকা।
সমস্ত ব্যথাভরা বিস্ময় উত্তীর্ণ, আঁধার-মানুষ আমি, আজ মৌনজড়
মৃত নয়, নিদ-মন, কঙ্কাবতীর শোভনশয়ান
তাই বুঝি মোহনরূপে সে নারী সর্বাঙ্গসুন্দর?
আমি পাপী, সে পবিত্র, এত বড়ো অপবাদ দেবো না তারে...
অহল্যা-অলিন্দ মোর, ভিনদেশী নিলয়, ভুল করে ছুঁয়ে ছিল পরশপাথরে।
সারা আকাশগঙ্গা আমার, কেটে যাই বাঁচার সাঁতার, খড়কুটো হাতড়ে
নোয়া না, আমি ন্যাকা, মাঝগাঙে মনে পড়ে -
নাও কই হতভাগা!

নষ্টমাত্রা


কাদের বলছো এসব - এখনো?
এতদিনকার বিশ্বস্ত আনুগত্য
উপহারে পেয়েছ তো মোক্ষ,
নাঙা চিতার আগুন রাঙা
আরো কটা রুটি সেঁকবে -মুক্তমনা প্রজাতণ্ত্রী কর্তৃপক্ষ।
ওরা নাহয় তাই
তোমারও কি চক্ষুলজ্জা নাই?
সত্যির পাঁচালী খুলেছো যাদের কাছে
ওরা সচ্চরিত্র - সুযোগ পেলেই বুকে হাঁটে।

পেট্র্যাপোলের পাগলিদিদি


ইয়ারো আনভিসিটেড, ভিসিটেড, য়্যান্ড রিভিসিটেড।

ঠিক এভাবেই শুরুটা করতে ইচ্ছে করছে, আর কোনোভাবে নয়, শুধু এদের ক্রমটা একটু পাল্টে নিতে হবে - এই যা।

এখানে আসতে না আসতে ঝোঁকের মাথায় যেটাকে ( অভিনন্দন… ) লেখা বলে চালাতে চেষ্টা করেছিলুম - আমার অভিজ্ঞতা ছিল ঐ ইয়ারো ভিসিটেডের কবির মতই।

তারপরে, যখন গল্পের পিঁপড়ের মত দু-একখানা চিনির সন্ধান পেয়ে মনটা একটু চাঙ্গা হল, সেই আমেজে মজে আরেকবার লেখার ( মুখোশের আড়ালে ) ভূত চাপল মাথায় - ইয়ারোকে চোখে না দেখতে পেলেও তার সম্পর্কে বেশ খানিকটা জানতে পারা গেল।

এবার হয়েছে আসল মজা। ঐ রিভিসিট করতে গিয়ে পিঁপড়ে বেচারা পুরো চিনির বস্তাটারই সন্ধান পেয়ে গেছে। তাই আজ সে পুরো হতভম্ব, এবং তার চেয়েও বেশি, চল্লিশ চোরের সমস্ত ধনরত্নের সামনে দাঁড়িয়ে আলিবাবার যে অবস্থা হয়েছিল।

তবে এরকম কোনো ঘটনা ( নাকি দুর্ঘটনা! ) যে আমার জীবনে ঘটবে, এটা বেশ, বেশই স্বাভাবিক ব্যাপার।

কেন নয়? লাম্পট্য যার স্বভাবে, এখানে আসতে না আসতেই তাকে যদি রাইয়ের মতো কোনো টপ-টু-বটম সুন্দরী মেয়ে টিজ করে, সেই কবিতা-বলা কাজলাদিদির প্রেমে পড়া ছাড়া আর কি কোনো গতি আছে কি এই হতভাগ্যের!

বহিরঙ্গের সৌন্দর্যতা অনুসন্ধানে উঠে আসে অন্তরঙ্গের সুর, কবিতা থেকে কবিমানসের যাত্রাপথে হয়ে যায় এই পাপীর মানস-কৈলাস দর্শন, রা…গ…ই…ম…ন।

আ বিউটিফুল মাইন্ড। পেপারব্যাকটা বেশি ভালো নাকি সিনেমাটা?

যারা এই প্রশ্নটা শুনে ভাবছেন, ব্যক্তি রাই আর রাগ ইমন নামের কোনো ( ইন! ) ফেমাস ব্লগারের তুলনা করে বেশ কিছুটা বাইট খরচা করব আজকে, তাঁদের কিন্তু বেশ হতাশই হতে হবে।

যার গলায় সুর, মনে সুর, লেখায় শব্দের ঝংকার - তাঁর মুল্যায়ন করার মত দু:সাহস আমি ধার পাব কোথা থেকে?

যদি সাফল্যের মাপকাঠি হয় আমি কতজন লোকের উপকার করতে পেরেছি - তাহলে শুরুতেই তো আমি খুব সুন্দর একটা শূন্য পেয়ে বসব।

আশা করি এবার সবাই বুঝতে পেরেছেন আমার দৈন্যদশাটা, যার সম্পর্কে একটু বলবার চেষ্টা করছি আজকে, সাফল্যের ব্যাখ্যায় তাঁর কথাই তো ধার নিতে হচ্ছে - এবং তাঁর কোনো অনুমতি না নিয়েই।

অনুমতি নিইনি এই আশায় যে, হয়ত বা তা এখনো অলীক সুখস্বপ্নই, তবুও তাই ভেবেই ভালো লাগছে এই একটা কথাই ভেবে - দিদির কোনো জিনিস নিলে ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হয়না।

মাঝে মাঝে আমার মতো ট্রেডমার্ক-নির্বোধও এক এক সময় বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে ফেলে - ওকে দিদি বানিয়ে ঠিক সেই কথাটাই মনে হচ্ছে।

এই মেয়েটাকে যদি বোন বানাতুম, তাহলে ঐ অপরূপ ভগিনীটিকে যে কি উপায়ে সামলানো যেত, সে সওয়াল করতে ছুটে যেতে হত খুব সম্ভবত সৃষ্টিকর্তার কাছেই।

তার চেয়ে ও আমার দিদি হয়েই থাক, কেঁদেকেটে পায়ে আছড়ে পড়লে, দূরে সরিয়ে যে দেবেনা - সে বিশ্বাসটুকু আমার আছে।

কত জন লোকের উপকার আপনি করতে পেরেছেন, নাকি, কত জন লোক আপনার দ্বারা উপকৃত হয়েছে - রাইকে বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ঠিক সেখানে, যেখানে সাফল্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ও বেছে নিয়েছে প্রথম পছন্দটিকে, পরিত্যাগ করেছে দ্বিতীয়টিকে।

এক কথায় বলতে গেলে, দিসিজ ওয়ন অব দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল স্টেটমেন্টস আয়্যাভ এভার হার্ড, এবং এটিকে স্বচ্ছন্দে ওর জীবনের সামারিও বলা যায় - আসলে তা কিন্তু ওর লক্ষ্যপূরণেরই লগারিদ্ম।

ওকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, যে ওর নিজের জীবনটা তুলনামূলকভাবে বেশ বেসুরো, এমন কিছু জিনিস ও পেয়েছে যা নাকি আরো কয়েক বছর পরে পেলেই বোধ হয় ভালো হত -আসলে ঐটেই ওর মস্ত বড়ো চালাকি।

সুরঙ্গমার মুখে এমন কথা শুনলে সেটাকে মস্ত এক তামাশা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?

অনেক জিনিস ভালো করে দেখতে গেলে চোখ দুটোকে কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ করে নিতে হয়, আর তখনই অন্তর আর বাহিরের আপাত-বিরোধ মুহূর্তে যায় মিটে, প্রেম আর বিরহ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় - পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মিলনের মতই প্রেম-অপ্রেমের নিষেকে, অ-সুরের মাঝেই অভিষেক হয়ে যায় সুরের, প্রেমিকের এক-সিগারেট-প্রতীক্ষার চেয়েও কম সময়ে।

প্যাসপোর্টের ধুলো ঝেড়ে রাইকে সাথে করে একদিন সামনাসামনি তর্কে বসার ইচ্ছে আছে আমার, যেখানে আপনাদের প্রবেশ নিষেধ ( ! ), ছোটোবেলার থেকে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করব ওকে - খুউব করে যখন কান্না পায় তখন কবিতা আর কাঁধের মধ্যে কোনটা দরকার?

কে জিতবে আর কে হারবে তা এখানে অবান্তর। কবিতার পক্ষ নিয়ে তর্ক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, আমারই কাঁধে মাথা রেখে খানিকটা জিরিয়ে নেবে ও, আর ওর ছোট্ট ভাইটা যদি হেরে গিয়ে ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে - শোলোক বলতে বলতে তার কান্না থামিয়ে দেবে ও।

দরকার শুধু এইটুকুই বুঝবার - শব্দের সাইফার ছেড়ে জেগে ওঠা সদ্যোজাত এক সম্পর্কের অঙ্গীকার।

ফিরে আসা যাক সেই পিঁপড়েটার কথায়। বিতর্ককে বুঝতে গিয়ে একটু বেশিই বুঝে ফেলেছিস, আর তোর প্রাপ্তির ঝুলিটাও যেন ভারি ভারি ঠেকছে, এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা - মরতে আবার কেন এলি এই বেলতলায়?

ফিরে এলাম একটা কারণেই, নতুন নতুন এসে যে ভুলটা করেছিলাম, সেই গ্রেভ এরর যেন নতুন করে আর কেউ না করে - পৃথিবীতে তো আমার মতো নির্বোধের আর অভাব নেই।

দূর থেকে জলঙ্গী ভেবে যাতে আমি ডুব-সাঁতারের কায়দা দেখাতে গেছিলাম, আজ সেখানে নাকানি-চোবানি খেতে খেতে বুঝতে পারছি অতলান্তিক গভীরতা কাকে বলে, আরও ভালো করে বুঝতে পারছি পার্সপেক্টিভ কথাটার গুরুত্ব।

আমার মতো দুরবস্থা যাতে নতুন আর কারও না হয়, সেই জন্যেই এখন খুব করে চেষ্টা চালাচ্ছি সিন্ধুকে বিন্দুতে স্কুইজ করে দেওয়ার, একটা এপিকের প্রেসি করার - যদিও কতখানি সফলভাবে তা করতে পারবো সে বিষয়ে নিজের সন্দেহই এখনো পর্যন্ত কাটেনি।

ওর সাংগঠনিক সাফল্যের কথায় আমি যাবো না। মার কাছে মামাবাড়ির গপ্পো শোনালে, বড়োমামুর খুব একটা বোধ হয় ভালো লাগে না ( কিন্তু কথাটা কে তুলল - শাহানা বোধ হয়! ), নিজের চোখেই তো দেখলেন সবাই কিছুদিন আগে!

ওর লেখার কথা বলতে গেলে, প্রথমেই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, লেখক না কবি - কার পক্ষ নেবো আমি?

নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি, রাই যেন ওর কবি-স্বত্তার প্রতি বেশ খানিকটা বায়াস্ড, সেই তুলনায় লেখককে খুব একটা সময় দেয়না - তবুও ওর এই অন্যায়-আচরণের কোনোরকম প্রতিবাদ করতে পারিনা।

কেন? ঐ হতচ্ছারি জানে কেন, আমার পুংকিসোনা বাচ্চা হলে কি হবে, আসলে ও বাচ্চা বলেই এক নিমেশে ধরে ফেলে - ওর চেয়ে বয়সে অ-নে-ক বড়োদের ছোট কিছু দুর্বলতার হাল-হদিশ।

রাইয়ের প্রতিটি কবিতায় বেশ কিছু কোর ফ্যাক্টর্স বা মৌলিক উপাদান থাকে, সেটা ভালো না খারাপ তা চিন্তা করে মাথা খারাপ করে কোনো লাভ নেই, চাঁদের গায়ের দাগকে কেউ তার কলঙ্ক বলে - কেউ বা বলে সৌন্দর্য।

ওর সুরেই বলছি আবার - আন্দাজ আপনা আপনা!

ভ্রমর দেখলে আপনি কি তার চরণ গুনতে বসবেন, নাকি তার আচরণের অস্থিরতা উপভোগ করবেন, একটু পড়তে চেষ্টা করবেন কি কখনো তার কবিতা-না-হয়ে-ওঠা কথা না বলতে পারার যণ্ত্রণাকে - যে নীরব ভাষার সমস্ত বর্ণগুলিই ঢাকা পড়ে গেছে ইশ্বর-প্রদত্ত এই আপাত-বর্ণময় পাখাদুটিতে।

ভ্রমরের প্রসঙ্গটা এখানে একেবারেই অসঙ্গত, তবুও কারো একজনের ঋণ পরিশোধেই তার আলোচনা, হোক না তা যতই অপ্রাসঙ্গিক - অর্থহীন।

আবার ফিরে যাই ফ্যাক্টর্সে। একটি উপাদান ঠিক যেন জ্যাক-ইন-দ্য-বক্সের মতো, ইনস্ট্যান্ট ইমপ্যাক্ট করে, নরম পানীয়ের বোতল খুললে যেমন ভস করে ওঠে - বা বলা যেতে পারে ওয়েবপেজে হঠাত করে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া কোনো ফ্ল্যাশ-এফেক্টেরই মতো।

ওর কবিতার যে তাত্ক্ষণিক আবেদন, সেটার সঙ্গে অনেক কিছুরই তুলনা টানা যেতে পারে, এই মুহূর্তে মারাত্মক লোভ লাগছে তাকে ওয়েল্কাম টু সারায়েভোর একটি বিশেষ সেকোয়েন্সের পাশাপাশি রাখতে।

ছবি যখন প্রায় শেষের মুখে, তখন একটা য়্যাডপ্টেড বাচ্চাকে পর্দায় দেখা যায়, সে তার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করছে।

সে তার মাতৃভাষা জানেনা, তাই ইংরিজিতেই কথা চালিয়ে যায়, তার মা কিচ্ছু বুঝতে পারেনা - তবুও তিনিও নিজের ভাষাতেই আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

দুজনেই দুজনের কথা বুঝতে পারেনা, একে অপরের কথা হারিয়ে যায় ভাষাগত দুর্বোধ্যতায়, তবুও তারা বলে যায় - যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।

ঠিক এই জায়গাটাতেই আমরা সিনেমার বেস থিমের সঙ্গে কানেক্টেড হয়ে যাই, কেউ যদি প্রথম থেকে ফলো নাও করে থাকে, কেবলমাত্র এইটুকু দেখেই সে বুকে তুলে নিতে পারে গল্পের মূল সুর।

রাই তার পোয়েটিক য়্যাপ্রোচে এতটাই পাওয়ারফুল।

ওর প্রতিটি কবিতাতে প্রত্যেকেই কানেক্টেড হয়ে যায়, তত্ক্ষণাত, কিন্তু নিজের মতো করে। এই আরেকটি ফ্যাক্টরের জন্যে, যে পড়ছে, আর যে লিখছে - তারা দুজনে একই মানসিক সমান্তরালে পৌঁছে যায়, আলাদা আলাদা করে, তবুও একই সাথে।

ওর কবিতার ট্রিটমেন্টে অনেক সময় অনেকে ডিস্ট্র্র্যাক্টেড হয়ে যায়, রেগে গিয়ে বলে ফেলে যে জঘণ্য লাগছে, আসলে এটাও ওর এক ধরণের চালাকি। কবিকে নিজের মনের ভাব ঢাকতে গ্রটেস্ক মুডের সাহায্য নিতে হয়, করতে হয় কথার ক্যাম্যুফ্ল্যাজ, নইলে যে লোকে দেখে ফেলবে।

কি দেখবে?

এই দেখানো-লুকোনোর প্রশ্নে প্রায়শই কবি দ্বিধা-বিভক্ত, কত শতাংশ করা যেতে পারে পাঠককে তার যণ্ত্রণার অংশীদার, কোথায় বা টানব আমার লক্ষণসীমা?

কবির নিজস্ব একটা ল্যাস্ট লাইন অব ডিফেন্স আছে, যেটাকে পেরিয়ে কেউই তার কাছে পৌছতে পারেনা, কেবল মাত্র একজন ছাড়া।

এই গোপনীয়তাটুকুর প্রয়োজন আছে, সেটাই তার আব্রু, বিশেষ একজনের জন্যে তার যে আকুল প্রতীক্ষা - এই চিন্তার নগ্নতা দর্শনের অধিকার তো তাঁর মাঝি ছাড়া আর কারো নেই।

দিন গড়িয়ে আঁধার নামে, তবুও কবি ঘাটে বসে থাকেন, সবার মাঝি ফিরে আসে - আমার মাঝি নাই।

ভাবতে ইচ্ছা করেনা, ভাবতে ভয় লাগে, তবুও মনের কোণে বিপজ্জনকভাবে একটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে - পূর্ব-পশ্চিমের অলি আর আমার রাইয়ের মধ্যে কোনো মিল নেই তো?

উপন্যাসের উপসংহারে অলি নামের মেয়েটাকে কল্পনার কাদামাটি দিয়েই, পিগ্ম্যালিয়নের মতো একটু একটু করে গড়ে নিতে হয় তার পুরুষটিকে, তারই পুরুষ - শৌণককে।

বড়ো চিন্তায় পড়ে যাই কবির জন্যে, এই ডেসিগ্নেশন একবার কাঁখে তুলে নিয়েছেন বলেই কি তাঁকে সব রকম জৈবী চাহিদার ঊর্ধে উঠে যেতে হবে, জীবন আর যৌনতাকে আলাদা করে দেখার ত্রুটি ঠিক কি ভেবে তিনি করেন?

জীবনের জন্ম যে যৌনতা থেকেই, একথার মর্ম একজন কবির চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে?

তাই সেই জীবনেই লীন হয়ে থাকা যৌনতায় মগ্ন কবি লিখে ফেলেন তৃণস্তনের কথা।

মন্দাক্রান্তার কবিতা আমি একেবারেই পছণ্দ করিনা, শুধু রাইয়ের সঙ্গে তুলনা টানার জন্যে ওকে টানছি, কারণ দুজনের যাত্রা শুরুতে বেশ মজার একটা মেডিক্যাল মিল খুঁজে পাওয়া যায় - মন্দা তো বেশ অনেকদিনই সংসারী হয়েছে, আর কবিতাও ছাড়েনি, তবে রাই কেন এ ব্যাপারে এখনো আন্ডিসাইডেড?

নাকি ও অনেক দিন আগেই ভাবতে শিখে গেছে - যে ম্যারেজ ইজ আ সিভিলাইজ্ড প্রাশ্চিচ্যুশ্ন?

পলিগ্যামির প্রসঙ্গে ও স্বভাব-বিরুদ্ধ সতর্কতায় জবাব দিয়েছে যে ওটা লোকেদের ব্যক্তিগত ব্যপার।

সশিয়বায়লজি আমার অনেকগুলো প্রিয় বিষয়ের মধ্যে একটা। তাই এটা ওটা ঘাঁটতে গিয়ে পড়ে ফেলি - আ ন্যাচ্র্যাল হিস্ট্রি অব রেপ। হিন্দু মিথও খুব প্রিয়, জেনে যাই শ্বেতকেতু ও উদ্দালকের কথা, বিবাহপ্রথার প্রবর্তন।

এসব পড়ার পরেও একটা কথা বলছি, ডার্টি লিনেন্টা যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লজেটে একগাদা কাপড়চোপড়ের মাঝে চাপা পড়ে থাকে, তার কথা কেউ জানেনা - কিন্তু সেটাকে ওয়শ্রুমে নিয়ে গিয়ে বাসিনে ফ্যসেটের তলায় ধুতে গেলেই পাঁচজনের চোখে পড়ে যায়।

আমার চালানো গান শুনে যদি পাড়াপড়শি ছুটে আসে, তবে সেটা আর পার্স্নাল থাকে না, শব্দদূষণ হয়ে যায় - আইনের চোখে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

হু যে অনেকদিন আগেই সেফ সেক্স কথাটাকে সংশোধন করে সেফার সেক্স করে দিয়েছে - সেটা ম্যাস্ট্যার্স ইন পাব্লিক হেল্থে পড়ানো হয়না?

য়্যামেরিক্যায় কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের হার আগের চেয়ে এখন অনেক কম, আর তার একমাত্র কারণ হল সিরিয়্যাল মন্যগ্যামি, একথা রাইয়ের তো না জানার কোনো কারণ নেই।

আর নতুন আরেক প্রশ্ন এসে ভুলিয়ে দেয় পুরোনো প্রশ্নটাকে।

আমরা নিজেদের যে স্বপ্নের সাম্পানে কবিকে চড়াতে চাইছি, সেই ফ্রি রাইড তিনি তো প্রত্যাখ্যান করতেই পারেন, তবু তাঁর সঙ্গকামনার অভীপ্সায় গণধর্ষিত হতে হয় তাঁরই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রকে। এই আদরের যাঁতাকলে পড়ে রক্তাক্ত হতে থাকে তাঁর দেহ, যদিও আমরা বুঝতে পারিনা প্রিয়জনের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার সে যন্ত্রণাকে, ম্যারাইটল বা ডেট রেপের মতই তা নির্বাক-বিষ-জরজর।

এই সেদিনই রাস্তায় দেখা নাম-না-জানা ছোট্ট ফুটফুটে এক মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠেছিলাম -

খুকি!
তোরই চোখে চোখ রেখে -
এক্ষুণি বাবা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে
হোক না তা যতই আঠাশে আহাম্মুকি।

আমারই দেখা সেই মধ্যবিত্ত-স্বপ্নের শুরুতে ভেবে নিই, একদিন আমার রাইদিদিরও কোল আলো করে কেউ আসবে নিশ্চয়ই, আর কি অদ্ভূত - স্বপ্নশেষের অন্তিম লগ্নে ও আমারই মেয়ে হয়ে যায়।

সোহাগের এই বহুগামিতায় সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় - ছোট্ট তুমিন, পুংকিসোনা, আর রাগ ইমন।

আর ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই দেখতে পেয়ে যাই, প্রথম বারের মতো এবারে আর চোখ এড়িয়ে যায় না তা, আমাদের স্থূল স্বার্থপরতা আর দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা চোখের সামনে উত্কটভাবে প্রকট হয়ে ওঠে।

কখনো খেয়াল করে দেখেছেন, রাই এখন যা করে, ওর কর্মজীবন ওকে যাদের কাছাকাছি এনে দিয়েছে - এর পরেও কি বলবেন যে ও কারো মা নয়?

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কারো কবিতা পড়া যায় না, তার মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে যেতে হয়, এবং তা করতে হয় আক্ষরিকার্থেই চোখ বন্ধ করে - একবার চর্মচক্ষু বুজে মর্মচক্ষুটি খুলে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে!

কবিদের ধরা একটু শক্ত বটে কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব কোনো কাজ নয়।

রাইয়ের কবিতাকে অতিক্রম করতে করতে অনেক বার দেখেছি ও স্বেচ্ছাকৃতভাবে ডিস্টর্শন এনেছে, দেখতে দেখতে কখনো মনে হয়েছে এত বেশি কেন, আরেকটু কম হলে কি এমন ক্ষতি হত?

যে কোনো শিল্পে এই ডিস্টর্শন যদি ঠিক ঠিক প্রয়োগ করা যায়, তবে তার এফেক্টকে এক কথায় সার্প্লাস বলা যায়, দ্যালির ঘড়ির কথাই চিন্তা করুন একবার।

যারা পাঙ্ক রক শুনেছেন তাঁরাও ব্যাপারটাও বুঝতে পারবেন। গলার কাজের এত সূক্ষতা সেখানে, সুর নিয়ে সুন্দর আর অসুন্দরের খেলা, যে আমি আপনি তার চেষ্টা করতে গেলেই - হয়ে যাবে ঝামেলা!

এই শৈল্পিক বিকৃতির প্রয়োগ হচ্ছে অনেকটা নিউক্লিয় শক্তি নিয়ে খেলা করার মতই সাংঘাতিক, তবে আমি কিন্তু ওর কোনো সমালোচনা করছি না, আমার দৃষ্টিতে মনে হয়েছে কবি এই খেলাটা হয়ত নিজের অজান্তেই কোনো কোনো জায়গায় একটু অসতর্কভাবে করে ফেলেছেন।

কখনো কখনো যেন অসতর্ক ক্যামেরা একটু বেশিই জুম করে ফেলায় ধরা পড়ে গেছে ব্যালেরিনার পায়ের টেন্শন - তাই মনে হয় কোনো কোনো কবিতার কিছু কিছু জায়গায়।

রাইয়ের কবিতা পেরোতে পেরোতে মনে হয়েছে, কখনো যেন ও প্রি-মেনোপজাল সিন্ড্রোমে আচ্ছন্ন, আবার কখনো যেন কবি পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনে ব্যথাতুর - কিন্তু কেন এই শব্দের স্কিজফ্রেনিয়া রাইকে ঘিরে নেয় মাঝে মাঝে?

সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বড়ো কঠিন, কারণ, আজ স্বীকার কোনো দ্বিধা নেই - একদিন এই বোকচন্দরও তো নিজের জীবনে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটা অক্ষম প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

যতদূর মনে হয়, ও তখন একটা শেলে ঢুকে পড়ে, য়্যাকচুয়্যালি শি ডিস্কানেক্টস হার্সেল্ফ ফ্রম এভ্রিথিং য়্যু নৌ।

কিন্তু কেন? হয়ত একেক সময় জ্যুভেনাইল চাইল্ড আর পাব্লিক হেল্থ ও ওয়েলফেয়ারে নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বড়ো বেশি করে ওর প্রাণের পরে বাজে।

আবার হয়ত বা, সেই মাঝির জন্যেও, আমার মাঝি কই - আমার মাঝি নাই।

হয়ত একথা ভেবেই অনেক দিনের পুঞ্জীভূত হতাশার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে, যে ওকে বোধ হয় শব্দের আঁচল দিয়ে নিজের চোখ দুটিকে নিজেই মুছে নিতে হবে, শেষ পর্যন্ত কেউই আর এগিয়ে এসে ওর চুলগুলোকে ঘেঁটে দিয়ে বলবে না - চল যাই তোকে নিয়ে এই নড়কের বাহিরে।

আসলে সমস্যাটা হল, এটাকে অবশ্য সমস্যা বলা যাবে কিনা জানিনা, কবিদের একটা বিশেষ জিনিস থাকে - যেটাকে পোয়েটস ভ্যানিটি বলা যেতে পারে।

আর এর গায়ে আমাদের একটু অসাবধানী আঁচড় লাগলেই, কবি যেন তেন প্রকারেণ সেটাকে রক্ষা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, আমাদেরই চোখে ফ্যানাটিক হয়ে ওঠেন।

সেটাই স্বাভাবিক তাঁর পক্ষে, কারণ তা হল তাঁর শেষ পারানির কড়ি, পান্থজনের রূদ্ধসখা - সেটাই তাঁর সর্বস্ব।

এর কাছে সব, সবকিছু তুচ্ছ, এমনকি সমস্ত সম্পর্কও।

কবির এই ভ্যানিটি যে কত সূক্ষ্ম তা বোঝাতে গেলে একটা রোবাটিক হাতের কথা বলতে হয়। মানুষের মস্তিষ্ক চট করে আণ্দাজ করে নেয় কোনটা কাচ আর কোনটা ইস্পাত। কিন্তু অতি সামান্য একটা কাচের গেলাসকে না ভেঙ্গে, একটা রোবাটকে ঠিকঠাক ধরতে বললে, তার ঐ হাতটা বানাতে লেগে যায় কম করে কয়েকশটা সফিস্টিকেটেড মোটর্স আর য়্যাকচুয়েটর্স। তার পরেও দরকার পরে তাকে আর্টিফিশিয়ালি ইন্টেলিজেন্ট ভিশন দিয়ে চক্ষুষ্মান করার প্রয়োজন।

আমাদের অবস্থা ঐ ডাম্ব রোবাটটার মতোই।

কবির কবিতায় বারে বারে উঠে আসে নেগেটিভ এমোশন্স, আঁকা হয়ে যায় মানুষের ওপর থেকে তাঁর বিশ্বাস হারানোর তেলছবি, জলছবি কথাটা এখানে বেমানান কারণ কবির আবেগ এখানে বেশ সান্দ্র।

ঠিক এইখানেই কবিকে প্রশ্ন করতে মন চায়, হ্যাভ ফেইথ ইন গড য়্যান্ড লক ইয়র কার, এই কথাটা তুমি কোনোদিন শোনোনি রাই?

ঠাকুরের ভাষাতেই বলি, মানুষকে বিশ্বাসও কর,আবার তাকে যাচাই করেও নাও - বাজিয়ে নিতে কেউ কি বারণ করেছে তোমায়?

প্যান্ডোরার বাক্স নামের কোনো গল্পের কথা কোন সে ছোটোবেলায় পড়েছ বলেই কি আজ তোমার এই বিস্মরণ?

এই বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বলেই মাথার থেকে ডিঙ্কের ভূত নেমেছে, আমি তাই জোর গলায় বলি, এই নড়ককে স্বর্গ করতেই আরো বেশি করে প্রয়োজন কলকাতার যীশুদের - উলঙ্গ রাজাদের বুকে ভৃগুর পদচিহ্ন আঁকতে গেলে সবার আগে দরকার এই রাজার রাজাদের।

অনেকদিন আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম মনে নেই, শুধু মনে আছে যে ইংরিজি সাবটাইটল্স ছিল।

একটা শিশু, যে তখনও মাতৃগর্ভে, আর তার মায়ের গল্প।

বাচ্চাটা সব দেখে, সবকিছু নিয়ে কথা বলে তার মায়ের সঙ্গে, আর সিনেমার শেষে বলে ওঠে মা…।

সে বলে, মা আমি এত হিংসা-মারামারি দেখে জন্ম নেবোনা ঠিক করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম - তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।

তাই নয়-এগারো হওয়ার পরেও আবার সাধারণ মানুষের শবদেহের উপরেই গড়ে উঠেছে নতুন সম্পর্কেরই ভিত।

রাই, লক্ষ্মী মা আমার, তুমি এটা নিয়ে একবার একটু ভেবো - কেমন?

কবি মাঝে মাঝে বেশ প্রেডিক্টিভ হয়ে যান, প্রশ্ন হল, ঠিক কতটা হবেন তিনি - বা কতটা হওয়া তাঁকে মানায়?

আমার মতে, আমি যদি ডেলিভারির সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিই যে আপনি ইয়র্কার ছুঁড়েছেন, তাহলে তো সব মজাই নষ্ট - তাই না?

ওর কবিতার প্যাটার্নে মাঝে মাঝে রিপিটেশন ঘটে যায় - সেকি ইচ্ছাকৃতভাবেই?

এক প্যাটার্ন ভেঙে বেরিয়ে আসবে আরেক নতুন প্যাটার্ন, আবার তার থেকে জন্ম নেবে অন্য একটা, এইভাবেই ঘুরবে কথার কেল্যাইডোস্কোপ - সেইটেই কাম্য।

আমার মনে হয়, যদি হাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে দেখা যায়, তবে সেই সমস্ত ডুপ্লিকেটের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে বেশ কিছু সূক্ষ্ম ভেরাইটি - মালদার মসজিদে যেমনটি দেখেছিলুম।

জমজ বাচ্চারও হাতের ছাপ কিন্তু এক হয়না কখনো।

ইংরিজিতে একটা কথা আছে - সাক্সেস ইজ আ লাউজি টিচার।

কবিকে বেশ কয়েক বার আন্ডার্পার্ফর্ম্ড মনে হয়েছে - কিন্তু সেখানেও আছে সমস্যা।

আমি আপনাকে যে রেটিংই দিই না কেন, য়্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে ইটস য়্যু, নট মি - হুস গনা ডিসাইড হুস ইয়র ডিয়ারেস্ট বৈবি।

য়্যান্ড দ্যাটস জাস্ট ওয়ট রিলি ম্যাটার্স।

কবির নিজস্ব কি কোনো স্টাইল থাকবে?

এর সমর্থকেরা বলেন, অবশ্যই, সেটাই তো পেডিগ্রীর কাজ করবে - যাতে তাঁর ব্র্যান্ডটি ভালো করে এস্ট্যাব্লিশ্ড হতে পারে।

আর এর বিরোধীরা বলেন, কবি যতই এক্সপেরিমেন্ট করবেন, বাড়ে বাড়ে নিজের ফর্ম ভাঙবেন - ভাবে ভাবনায় ডাইভার্স হয়ে উঠবেন, তাঁর লেখায় যত বাড়বে ফ্লেক্সিব্লিটি আর ফ্লুইডিটি, তবেই জমবে আসল মজা।

এক বাটি জল নিয়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিন। এবার আধ ঘন্টাটাক পরে ওটাকে বের করে আনুন, কি দেখতে পাচ্ছেন, বরফ হয়ে গেছে না?

ব্যাস, আর কোনো কথা না ভেবে হাত দিয়ে চাপ দিন, মুড়মুড় করে ভেঙে ভেতরের জল বেরিয়ে যাচ্ছে তো?

ওর ওপরটা জমাট বেঁধেছে, ভেতরে ভেতরে এখনো ও নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে যাচ্ছে, তাই ওকে নির্দিষ্ট কোনো ছাঁচে ফেলার সময় এখনো আসেনি - পাগলি আমার এখনো ইন্টার্ল্যুড নিয়েই খেলা করে যাচ্ছে, মন্দিরের গর্ভগৃহই ওর সবচে পছন্দ, কবিতার কেন্দ্রক বলে যেটাকে।

মাঝে মাঝে একটা কথা ভেবে বেশ মজা পাই - ওর নামটার কথা চিন্তা করে।

যার নাম বিমান সে যদি প্লেন চালায় তবে তার চে বেশি মজার আর কি কিছু আছে নাকি?

রাইয়ের ল্যাস্ট নেমের কথা চিন্তা করুন একবার - কি সেটা? কবিতার মাধ্যমে ও তো তাই করেই যাচ্ছে।

এবারে ওর ফার্স্ট নেমের কথা ভাবুন - মনে পড়েছে? সেটা আবার শুরু হচ্ছে বাংলা বর্ণমালার প্রথম বর্ণটি দিয়ে, সে নাম ওর মতো কাব্যসিসৃক্ষু লোকজনেরই সাজে, যারা মৌলিক কিছুর সর্জনাকাঙ্খা নিয়ে জন্ম নিয়েছে এই ধরার পরে।

দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি কবির স্বভাবসিদ্ধ। তাই ও ইমন রাগ বেছে না নিয়ে নিয়েছে রাগ ইমন। ওর এই নামকরণ থেকেই বোঝা যায় ওর রসবোধ কতটা উচ্চমাত্রার। সবকিছুই ও একটু স্পিন দিয়ে ছেড়ে দেয় - একটু টুইস্ট করে দেখায়।

ঠিক এই কারণেই অনেক কবিতায় ওকে রাগি মনে হয়, যেন ফেমিনিজ্মের ফেনায় ভরপুর, আসলে ওটা ওর ক্ষোভ।

ও অনেকের জন্যে অনেক কিছুই করতে চায়, কিন্তু সেই তুলনায় হয়ে ওঠে অল্প কিছু কাজ, ওর পার্থিব ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অনুভবে ও নিজের ওপরেই রেগে ওঠে।

নতুন করে খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের চারপাশে রোজই অনেক নবান্ন অভিনীত হয়।

যে ছেলেটা গাড়িতে বসা বাবুদের কাছে ভিক্ষে চাইতে গিয়ে, তাদেরই কোনো একজনের হাতের ঠেলা খেয়ে যখন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে, তার মা কিন্তু তখন তাকেই একটার পর একটা চড় মারতে থাকে - মেরেই যায়।

কারণ, ঐ গাড়িতে বসা লোকেরা তার নাগালের বাইরে, আর এই চড় মারতে মারতেই নিজের চোখের জলটাকে আড়াল করে সে।

রাই হল সেই মা।

এই জাতীয় পলিমর্ফিক কাব্যচেতনার পরিণত প্রকাশে কবি অসম্ভব রকমের পারঙ্গম, ভাবলে অবাক হয়ে যাই যে এত অল্প বয়সে ও কি করে এত এফেক্টিভ্লি এটা করছে, আর তখনই মনে নতুন ভাবনার উদয় হয় - ভয় হয় পাছে প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলি।

কেউ একবার খেয়াল করেছেন কি কখনো, হেমিঙওয়ে যে বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন, রাইয়ের বয়সটা কিন্তু ওরই ধারেকাছে ঘোরাফেরা করছে?

তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখি যে ও আমাদের আরো অনেক দিন জ্বালাবে!

শব্দের সুড্যক্যু খেলা কবির বেশ পছন্দ। আমরা জানি বাঙলার মসলিন কে কেড়ে নিয়েছিল। কবি কিন্তু সরাসরি তাদের নামোচ্চারণ না করে মিশরের শাসক সম্প্রদায়ের কথা বললেন একটি শব্দবন্ধের আশ্রয়ে - ফের‌্যাওয়ের হাত।

ব্যাস, ঐটুকুই, ঠিক মুড ঠিকভাবেই রিফ্লেক্টেড হল পাঠকের কাছে।

এর থেকে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে যায়, কবি আমাদের হাতে ধরা দিতে দিতেও শেষ মুহূর্তে পিছলে বেরিয়ে যান, ফাঁকি দেন বেশি - ধরা কম।

তাই কবির মনে যে কি আছে সে সম্পর্কে শেষ কথা বলতে পারে না কেউই। কবির মন সর্বদা উদাস-চঞ্চল, ঠিক একটি এলেক্ট্রনের মতই, হয়জেন্বার্গের আন্সার্টিন্টি প্রিন্সিপ্লের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে - তাই না?

একটা ব্যাপার দেখে বেশ ভালো লাগল, মুড অব এক্সট্রিমিটি বা চরম বৈপরীত্যভাব সৃষ্টিতে ও অসাধারণ রকমের গিফ্টেড, এক সময় এটা আমারও খুব প্রিয় খেলা ছিল - তবে তার থেকে পাতে দেওয়ার মত কিছুই বের করে উঠতে পারিনি কোনোদিন।

শাডারিঙ ইফেক্ট তৈরী করতে সক্ষম, এরকম অস্ত্রের ব্যবহারে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা যে কোনো কবির কাছেই খুব য়্যাডিক্টিভ একটা অনুভূতি - দেখলাম রাইও তার ব্যতিক্রম নয়।

এটা পাঠকের কাছে একটা ফ্রি-ফলিঙ জির-গ্র্যাভিটি জাতীয় সেন্সেশন এনে দেয়। রাই এটাকে সাধারণত: ব্যবহার করে আমাদের কন্সিন্সটাকে ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্যে, সুখকে স্বস্তি ভেবে যে স্বপ্নটা দেখে চলেছি সবাই, তার ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে।

হ্যাভ য়্যু নৌ থট, ঔ ড্রিমারদ্যাটিট মে বি অল মায়া, ইল্যুশ্ন?

এই কথাটাই ও বলে চলে, অবিরাম, অক্লান্তভাবে।

আমি ইচ্ছে করেই ওর কবিতা থেকে কোনো উদাহরণ দিচ্ছিনা, কারণ, এতে শ্রেষ্ঠ কোনো পঙক্তির অজ্ঞাতে বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে প্রচুর।

তার চে আমার খারাপ কবিতা থেকে একটা দুর্বল উদাহরণ তুলে ধরছি - তালেই ব্যাপারটা চট করে বোঝানো যাবে।

গহন চুলের নরম শাসন। নরম শাসন! এই শব্দের স্লিপ আর কথার রোল্যার-কোস্ট্যারে চড়ার মজা আজ শুধুই ইতিহাস আমার কাছে।

একটা কথা আমাদের কখনো ভুললে চলবে না যে - ব্যক্তি ও চারিত্রপূজার দোটানায় আমরা যেন কোনোদিন আসল মানুষটাকে হারিয়ে না ফেলি। নিন্দা-প্রশংসার ফুলমালার তলে যেন দেবীবিগ্রহ কোনোদিন চাপা পড়ে না যায়। অনেকের কাছেই মস্ত একটা সমস্যা যে ব্লগার ও ব্যক্তিকে কি সত্যি মেলানো যায় - নাকি মেলানো উচিত?

ম্যাপ দেখেছেন নিশ্চয়ই? এটা ভূমধ্যসাগর, ওটা বঙ্গোপসাগর, দাগ কেটে সব আলাদা করা।

এবার জয় মা বলে জলে নামুন - কি হল? আমি যদি জিজ্ঞেস করি কোনটে কি - বলতে ভুল হবে না নিশ্চয়ই!

কেউই আলাদা নয়, বরঞ্চ একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ভীষণভাবে।

কয়েক বছর আগে সার্নে একটা পরীক্ষা হয়েছিল - পার্টিক্ল কোল্যাইড্যারে দুটি মৌলিক মেসন-কণা নিয়ে। মজাটা হল, যখন প্রথমটিকে কিছুটা এনার্জি দিলে সে যেভাবে বিহেভ করছে, দ্বিতীয়টাও দেখা গেল হুবহু ঐ একই আচরণ করছে -এবং তারা ফিজিক্যালি য়্যাপার্ট কোয়াইট আ লট।

সিনেমায় যেমন দেখায়, একটা জমজ বাচ্চা কাঁদলে অন্যটাও যেমন কাঁদে, যদিও রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়ায় তখন সে অন্য বাড়িতে বসে!

ঠাকুর যেমন বলেছেন, আমার মধ্যেও ঐ আমি, তোমার মধ্যেও ঐ আমি - খেলা শেষের পরে সব এই আমি ঐ আমিতে মিশে যাবে।

এর পরেও যদি কিছু বুঝতে না পারেন তবে তার দায়ভার কিন্তু এই অধম নেবে না!

ব্লগারদের তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়- উত্তম, মধ্যম, অধম।

যারা শক্তকে সহজ আর সহজকে আরো সরল করে দেন তাঁরা প্রথমোক্ত শ্রেণীটিতে পড়েন।

মধ্যমদের কাছে শক্ত শক্ত আর সহজ সহজই থাকে।

আর যারা সহজ কথা শক্ত করে, আর শক্ত কথা আরো শক্ত করে বলে, তারা হল অধম - আমিই সেই হতভাগ্য!

আমরা হলাম অনেকটা সুপার্নোভার মতো, সেই ক্ষণিকের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে লোকে ভুল করে ফেলে, ফ্ল্যুক লেখাগুলোকে ফেলে দেয় ভালোর দলে!

তাই নিজের থেকেই ইচ্ছে করে রাইকে ক্যাম্প-ফায়ারের সঙ্গে তুলনা করতে, সে আগুনের ওম আর্তের সঙ্গী, দূর থেকে পথহারাকে পথে ফিরিয়ে দিতে ভুল করে না কখনো।

যদিও - সেই আগুনের শিখা দেখে অনেকে ওটাকে ওর ক্রোধ ভাবার ভুলটি করে। আরও একবার ওর হিউমার-বোধের সফিস্টিকেসির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেটা অনেকটা প্যান্টোমাইম জাতীয়, সত্যানুষঙ্গতার ইন্যুয়েন্ডোয় উদ্ভাসিত।

একবার আইনস্টাইন তাঁর এক বন্ধুকে একটি বই ধার দিয়েছিলেন পড়তে।

তো, এক সপ্তাহ পরে সেই বন্ধুটি যখন বইটি ফেরত দিতে এলেন, য়্যালবার্ট জিজ্ঞেস করলেন - কেমন লাগল?

বড্ডো বোরিঙ!

ইউক্লিডের জ্যামিতি পড়ে একঘেঁয়ে লেগেছে শুনে, সেদিন নাকি তিনি পাক্কা পাঁচ মিনিট ধরে হেসেছিলেন, এমন কথাই বলেন আইনস্টাইন-রিসার্চাররা।

একটা পুরোনো জোকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে - সিআইএ আর কেজিবিতে তফাত কি?

মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা যখন লোক সাজায়, তখন তার মধ্যে ছোট্ট একটা ফাঁক রয়ে যায় - তার মধ্যে দিয়ে চোর ঢুকে চুরি করে পালিয়ে যায়।

আর রাশ্যান ইন্টেলিজেন্স যখন ডিপ্লয় করে, তখন ইচ্ছে করে একটা ফাঁক রেখে দেয়, যাতে চোর সেটা দেখে বোকার মত নাক গলিয়ে দেয়।

রাইয়ের চরিত্রে যেগুলোকে ফাঁক মনে হয়েছে দূর থেকে দেখে, সেগুলো খুব সম্ভবত এক একটা ফাঁকি, আমাদের মতো ধেড়ে ইঁদুর ধরার ফাঁদ।

আপনি ওর কবিতা হয়ত বুঝতে পারবেন একটু চেষ্টা করলে, আরেকটু চেষ্টা করলে কবিকেও হয়ত বুঝে ফেলতে পারবেন, কিন্তু রাইকে ধরতে পারবেন না কোনোদিনই - ও একটা টোট্যালিটি।

পাইয়ের সাঙ্খ্যমান আজ পর্যন্ত কেউ বের করতে পেরেছে কখনো?

কিংবা, ক্যালকুলসে পড়া সেই লিমিট আর কন্টিন্যুটি, তাই না?

হ্যাঁ, ওর মধ্যেও বেশ কিছু ইন্যাপ্রোপ্রিয়েসি ও ইম্ব্যালেন্স আছে, ও যে পার্ফেক্ট সেকথা বলব না আমি - কিন্তু নিখুঁত আছে কি কিছু এই সংসারে?

ওর যেটা সব চে বড়ো ইতিবাচক দিক, তার কথা তো আমি শুরুতেই বলেছি, যে ওর লক্ষ্যটা কিন্তু স্থির আছে।

আর আমরা ওপড়ানো জল-ঝাঁঝির দল কেবল এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

খাঁটি সোনা দিয়ে গয়না তয়ের হয়না, তাকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে যতটা খাদ মেশাতে হয়, রাইয়ের মধ্যে আছে ঠিক ঐটুকুই - হিসেবে তার চে এক আনা বেশি বা কম ওকে দিতে ভুলহয়নি বিধাতাপুরুষের।

ও নিজের অসম্পূর্নতাকে সঙ্গী করে নিয়ে পূর্ণতার যতটা কাছাকাছি যেতে পেরেছে - আমরা ওর থেকে ঠিক ততটাই দূরে দাঁড়িয়ে।

তবুও সম্মান-দূরত্ব রক্ষা করতে করতেই - ঠিক একদিন!

ঠিক একদিন এই অপাংক্তেয়রও মনে হয় - দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার প্রাণের পরে।

শব্দের সিঁড়িভাঙা অংক কষতে কষতে যত ছোট হয়ে আসে সেটা - প্রেম আর পূজা দেখি চোখের সামনে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

তাই অন্যের রাগ ইমন হয়ে ওঠে আমার দিদিভাই - শুধু আমারই কাছে সে - রাই!

পোয়েটস ভ্যানিটির বাঙলা প্রতিশব্দ হিসেবে বলা যেতে পারে চাপা অভিমান কথাটা।

তা যেন এক অগ্নিগোলক, আর এই আগুনের পরশমনির ছোঁয়াতেই কবি হয়ে ওঠেন শুদ্ধ, অবচেতন থেকে অতি-চেতনে ঘটে তাঁর অনায়াসোত্তীরণ।

এই আগুন নিয়ে খেলা করা ও বেটিরই সাজে - আর আমি চলে এসেছি ছিটকে। বিপ্লব করার সাধ ছিল এককালে, কিন্তু তাকে দীর্ঘজীবি করার সামর্থ ছিল না, তাই আজ আমার অবস্থা প্রাণ-বাঁচানো এক রাজসাক্ষীরই মতো।

কবির অন্তরে যতই অস্থিরতা ও অতৃপ্তি থাকবে, ততই তিনি মহাসত্যের কাছাকাছি পৌঁছবেন, এই যাত্রাপথে তিনি নিজেকে বারে বারে ইম্প্রভাইজ করবেন।

ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়ে যাবেন কবি, তবেই তাঁর হৃদয়-ধূপ জ্বলে সৃষ্টির সুগন্ধ বেরোবে, নিসর্গের মাঝে হবে নশ্বরের মুক্তি।

মেইট্রিক্সের নিয় যেভাবে একটার পর একটা লজিক-লুপ্স আর সিস্টেম-সাব্রুটিন অতিক্রম করে পৌঁছে গেছিল।

রাইয়ের কোনো কোনো কবিতায় আমরা রিপাল্স্ড হয়ে যাই - দু:খ পাই। কিন্তু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি বলে খেয়াল করিনা যে, শব্দের সাঁকোর ওপারে ও অনেক আশা করে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ এসে ওর হাতটি ধরবে বলে।

আমাদের দু:খে কাঁদতে দেখে কবিও কাঁদেন - পাঠকদের কষ্ট দিয়েছেন বলে।

কবিরা এমনই হন - অভিমানী। তাই মুখ ফুটে ও কখনোই বলে উঠতে পারেনা - এসো।

যাতে শব্দের সেতু পেরিয়ে সম্পর্কের কোঠাবাড়িতে চলে আসতে পারি, কবি তাই বুকভরা আশা নিয়ে কবিতা লেখেন, কিন্তু আমাদের পদে পদে হোঁচট খেতে দেখে তাঁর সেই আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

তবে কবির মাথার যে কটি তার ছেঁড়া, সেগুলো জোড়া লাগানোর ভার ঐ মাঝির ওপরেই ছেড়ে দিন, তাঁর কাছেই আছে বন্ধ ঘরের চাবি - কবির মারণকাঠি-জিয়নকাঠি।

রাইয়ের সম্পর্কে আরেকটা ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে - যে ও ক্ষেত্রবিশেষে ম্যানিপুলেটিভ।

আমার মনে হয় ও একটু লুকোচুরি খেলতে ভালোবাসে - বাচ্চারা তো এমনটিই হয়।

যখন দৌড়তে দৌড়তে আপনার দম ফুরিয়ে যাবে একদম, চেঁচিয়ে উঠে বলে ফেলবেন, অ্যাই হতভাগী মেয়ে - আর পারছি না!

তখন ও এসে আপনার সামনে দাঁড়াবে, হাসতে হাসতে বলবে, কেমন জব্দ - কি মজা!

ধরে নিন এটা ওর একটা মানবিক লীলাখেলা - ত্যাগী আর ভোগীদের আলাদা করার পরীক্ষা।

আমার মতে, ওকে ধরার একমাত্র শর্টকাট হল, ওর হাতেই ধরা দেওয়া।

ওর কবিতাকে ন্যু-ইয়র্ক-স্টাইল স্যালস্যার সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। নাচের পরিভাষায় যাকে বলে শাইন্স বা চোখ-ধাঁধানো স্টেপিন্স, এই ভেরিয়েশনে তা একেবারেই নেই, একই রকমভাবে রাইও খুব-একটা অনাবশ্যক কথার কাটাকুটি খেলে না বলতেই পারি।

আগেই বলেছি - ওর কবিতার শর্ট-টার্ম ইফেক্ট হল সোডার বোতল খোলার মতোই।


এবার, কিছুক্ষণ পরে সে ফেনা থিতিয়ে গেলে পরে, বোঝা যায় আসল স্বাদটাকে।

আলোর ঝলসানি কেটে গেলে চোখ একটু একটু করে ধাতস্থ হতে শুরু করলে, তার পেছনে থাকা হেডলাইটটাকে দেখতে পাই আস্তে আস্তে, ঠিক এখান থেকে আমরা ওর কবিতার লঙ-টার্ম ইফেক্টের আওতায় এসে পড়ি।

সিয়েফেলের বিদ্যুত-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পরেও সেটা যেমন বেশ কিছুক্ষণ ভাস্বর হয়ে থাকে - কঙ্গো-ব্যাঞ্জোতে একবার কাঠি ছোঁয়ালেই বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাজতে থাকে সেটা।

ঠিক যেন একটা হত্তুকির মত, প্রথমে মুখে দিলে তেতো লাগে, কিন্তু চেবাতে চেবাতে মিষ্টি লাগে।

কিংবা, ঠিক যেন একটা রুটির টুকরো, প্রথমে স্বাদহীন - চেবাতে চেবাতে ক্যার্বোহ্যাইড্রেট ভাঙতে আরম্ভ করলে মিষ্টি লাগবে।

বহুবার বলেছি, ওর কবিতা সমালোচনা বা মুল্যায়নের কোনো গুণই আমার নেই, আমি শুধু বারে বারে একটা জায়গাতেই জোর দিতে চাইছি - যেটা আমার মনে হয় সবাই মিস করে যাচ্ছি বারে বারে।

তাই একই ত্রুটি পৌণ:পুনিকভাবে হয়েই চলেছে।

যে লিখছে আর যে পড়ছে - তারা একই মানসিক সমান্তরালে পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আলাদা আলাদাভাবেই কাঁদছে।

যদ্দুর মনে হয় - এই বাধাটা আসছে উপযুক্ত অন্তর্দৃষ্টি আর স্ব-চেতনার অভাবে।

রকফোর্ড-খ্যাত নাগেশ কুকুনুরের অতি-সাম্প্রতিক ইর্ফানে, কোচ-টার্ন্ড-ড্রাঙ্কার্ড এক ব্যক্তির ভূমিকায় থাকা নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন, যখন দিল আর দিমাগ একসাথে কাজ করবে - তখন কোনো বাধাই আর বাধা হয়ে উঠবে না।

তাঁদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ত আলাদা, কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে যখন কবি আর পাঠক একসাথে পরস্পরের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন, ঠিক তখনই লেখা হয়ে যাবে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাটি - সম্পর্কের সার্থকতায়, তার উষ্ণতায়, তার থেকেই তো রসদ মিলবে নতুন এক স্বপ্নপূরণের।

শব্দের জটিলতা ছেড়ে সম্পর্কের গভীরতায় প্রবেশ করতে হবে।

রাইকে বোঝার চেষ্টা না করে ওকে বরঞ্চ শুনে যান - মীড় থেকে সমে - আবার সম থেকে মীড়ে।

আরেক বার ঐ ভ্রমরটিকে টেনে আনি, অপ্রাসঙ্গিকভাবে, তবু নিজস্ব অর্থবহতায়।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্যানিক্যার গ্র্যাস্প বোঝাতে একটা ফুলের উদাহরণ দিতে হয়।

ফুল রঙীন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে বইতে লেখা আছে - কোষরসের পি-এইচ ব্যালেন্সের জন্যে এমনটি হয়।

উত্তরটা কিন্তু অসম্পূর্ণ - আর এইখানেই প্রকট হয়ে পড়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

তাই বাকিটা জানার জন্যে ছুটতে হয় কবির কাছেই।

আলো যবে ভালোবেসে মালা দিল আঁধারের গলে,সৃষ্টি তারে বলে।

সেই ভালোবাসার আবির মেখেই ফুল আজ সার্থক সৃষ্টি হয়ে উঠেছে - তাই না?

রাইয়ের কবিতা যেন সোলো সঙ অব লাইফ, উইদ্যায়্যুট দ্য ম্যুজিক ট্র্যাক, কজ দেয়র্স নো নিড অব ইট।

ভালোই লাগুক বা খারাপ, ওর কবিতাকে কেউ অস্বীকার করে চলে যেতে পারেনা, একটা মাত্র পড়লেও আপনি রিয়্যাক্ট করবেনই।

সেই বৃদ্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এখন, গ্যালিব যাকে বলতে শুনেছেন, যদি একটি বারের তরে প্রিয়ার অধর-চুম্বন পান - তবে তিনি যুবক হবেন।

বড়ো আর বুড়োতে কি খুব তফাত?

ওর কবিতা কোন ঘারানা বা শৈলীর, তা আবিষ্কার করতে গিয়ে বারে বারে খুঁজে পাই, এমন কিছু এলিমেন্টস যা একেবারেই প্রিমিটিভ - রাংচিতার ঝোপে লেগে থাকা রোদ্দুরে আর পুরনো মোমবাতির পোড়া গন্ধের বিষণ্ণতায়।

অর্ধনারীশ্বর আর আরণ্যকের মতই তা আদিম মাত্রার।

এটা খুব সম্ভবত ওর সামগ্রিক কাব্যচেতনার গ্রুভ হিসেবে কাজ করে, খুব রুটের কাছাকাছি, আমার মত ছিন্নমূলেরা বড়ো বেশি করে সেটাকে অনুভব করে।

আর ওর কাব্যমন্থনের মোহে উঠে আসে আমার পূর্বজন্মের পাপ, চেয়ে দেখি, অচেনা শরীরে লেগে আছে চেনা ক্ষতেরই ছাপ।

লেখার জন্যে সব পাগলামিই করা যায়, ওর এই কথা শুনেও আমার হুঁশ ফেরে না, উল্টে চেষ্টা করি ওকে থামিয়ে দেওয়ার - এক আজব স্পর্ধায়।

পুরনো ক্ষত নতুন করে জেগে যাওয়ার ভয়ে, বাংলা বই পড়িনা, বাংলা গান শুনিনা - গত কয়েক বছর ধরে।

কিন্তু তাই বলে সেদিনের সত্যি আজ এত তাড়াতাড়ি মিথ্যে হয়ে যায় কি করে?

দু-হাজার সাল থেকে পাকাপাকিভাবে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু একদিন তো লেখার চেষ্টা করতাম, যদিও তা শেষ পর্যন্ত চেষ্টাই থেকে যেত।

প্রথম বার এক নি:শ্বাসে অনেকটা জীবনানন্দ পড়ে হঠাত ঝোঁক চাপল মাথায়, এমন একটা কিছু লেখার যেখানে কথা আর কবিতার সীমা যাবে মুছে, কথা হয়ে যাবে কবিতা আর কবিতা হয়ে উঠবে কথা - এশারের আঁকা ড্রয়িঙ হ্যান্ডসের মতই।

পাশে রাখা খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, তবুও লিখে চলেছি, হয়ত ভাবছি শিব - লেখা হয়ে যাচ্ছে শিবা। তবু লিখে যাচ্ছি, রাত জেগে, মা যাতে জানতে না পারে - বাবার চোখ রাঙানির ভয় কেন পাইনি সেকথা বলছি একটু পরে।

যখন টেক্নিক্যালি বেকার ছিলাম, মানে ছাত্র, তখনই হাজার হাজার টাকা খরচ করে আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের মত অনেক ইংরিজি নন-ফিকশন হার্ডব্যাকের অরিজিন্যাল এডিশন কিনে এনে গোগ্রাসে গিলতুম - ফিকশনস চিরদিনই আমার দুয়োরাণী ছিল।

প্রায়ভূকের মতই সব ধরনের না হলেও অনেক ধরনের গান শুনতাম।

যখন আরো ছোটো ছিলাম কি-বোর্ডস শিখতাম, অঞ্জন দত্তের পুরোনো গীটার শোনার পরেই, দুম করে ছেড়ে দিলাম তা - গীটারের কাছে সিন্থেসাইজরটা ভীষণভাবে ফাঁকির বাজনা বলে মনে হয়েছিল।

আজ বড়ো হয়েছি বলে পেট্রো-ডলারের পাগলামির বিষ মিশেছে রক্তে - তাই পাগলিদিদিকে বড়ো বড়ো জ্ঞানের কথা বলতে ছুটে গেছি।

এত তাড়াতাড়ি কি করে বিস্মৃত হই পূর্বজন্মের স্মৃতিকে?

একদিন আমিও তো যতটা পারি বলতে চেষ্টা করেছি, অদ্ভূত সে সময়ের কথা যখন মানুষের ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে যাণ্ত্রিক, আর যণ্ত্র হয়ে উঠছে ক্রমশ: মানবিক বোধসম্পন্ন - উঠে এসেছে টার্মিনেটর টু আর স্পেলব্যার্জের এ-আইয়ের কথা।

বলতে চেষ্টা করেছি ন্যাপ্যাম আর স্ক্যাড-পেট্রিয়টের পাগলামোর কথা।

বলতে চেয়েছি পাগলা জগাইয়ের কথা - একদিন যে এসে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবে যুদ্ধকারদের সব পাগলামো।

আর এই পাগলা জগাই যখন আমাদের সুস্থ্যতার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার চ্যালেঞ্জ জানায় - তখন আমরাই তাকে পাগল সাজিয়ে দিই এই সমাজের চোখে - স্বার্থপরতার এই স্যাবোট্যাজ থেকে বাদ পড়েনি আমার রাইও।

আজ অনেক দিন পরে এই এক্স-পাগল যখন তার পুরোনো খেরোর খাতা খুলে দেখে, যেখানে ইংরিজি-বাংলায় লেখা তথাকথিত গল্পোপন্যাস-রম্যরচনা-গল্পিকার সংখ্যা কয়েক ডজন, সেখানে কবিতার পাগলামি এসেছে কয়েকশ বার!

পাগলামি কাকে বলে - কে পাগল?

এই প্রশ্নেরই তো উত্তর খুঁজেছিলাম - কোনো একদিন।

স্যানিটি আর ইন্স্যানিটির অসমীকরণ সল্ভ করার নেশা ছাড়তে পারিনি এখনো - তাই প্রিয় বই বলতেই মুখে উঠে আসে স্টিভেন পিঙ্কারের দ্য ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের কথা।

গোস্ট ইন দ্য মাশিনের ভাবনা ভাবতে ভাবতে সৃষ্টির আদিকাল থেকে কত লোকেরই তো মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়।

যারা হার্বার্ট আর সিক্সটিন পার্ক য়্যাভিন্যু বানিয়েছেন - তাঁরাও ভেবেছেন নিজের মতো করেই।

কোথায় বোধের শেষ আর অবোধ্যতার শুরু, এটা জানতে তো সাইম্যুলেশন-রিভার্স এঞ্জিনিয়ারিঙ-ফাইনাইট অটমাটা ইত্যাদি কতো রকমেরই ম্যাথমেটিক্ল মডেল্স ব্যবহার করা হয়েছে, সুপার্কম্প্যুটিঙ ক্ল্যাস্ট্যার্সকে কাজে লাগিয়ে।

ন্যুরোসায়ন্সের রিসার্চাররা কোমর বেঁধে লেগেছেন, আদা-জল খেয়ে লেগে পড়েছেন কগ্নিটিভ বিশেষজ্ঞরাও, কিন্তু তাতে ধোঁয়াশা বাড়ছে বই কমছে না।

আজ পরমাণু বোমার চেয়েও শক্তিশালী অস্ত্র আছে উন্নত দেশগুলির ভাঁড়ারে, যাকে বলে বায়ো-ওয়েপেন্রি, কিন্তু পৃথিবীর সব চে সফিস্টিকেটেড মাশিনটি সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানিনা - দ্য য়্যুম্যান ব্রেন গড্যামিট!

জীবনানন্দের শেষ দিকের কিছু গল্পোপন্যাস পড়লে সব যায় গুলিয়ে - শব্দ নিয়ে কবির সেকি পাগলামি সেখানে।

ল্যুন্যা রুশ্ডির লেখা থেকে জানা যায় শেষ বয়সে তিনি নিজেকে ইশ্বর ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

কে আসল পাগল আর কে যে নকল, কে আপাত-সুস্থ্য আর কেই বা প্রকৃত, সব খেয়ালি হেঁয়ালি কেটে যাবে একটা ইমেলের কথা বললে।

এই লেখালেখির ধ্যাস্টামো করতে গিয়েই একদা এক ফিমেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল - সেই মাঝে মাঝে যোগাযোগ রাখে।

কয়েক মাস আগে ওর বিদেশ-ভ্রমণের কথা জানায় আমাকে। ওর নিজের ভাষাতেই বলি বাকিটুক…।

…বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমি একটা কফিশপে এসে বসলাম। বিশাল এলসিডিতে যখন নয়-এগারোর পুরনো ফাইলচিত্র দেখাচ্ছে তখন আমরা ক্যাপ্যুচিন্য আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়েই মশগুল। এমন সময় একটা বাচ্চার দিকে চোখ পড়ল, ও হাত দিয়ে স্ক্রীনটাকে ছুঁতে চাইছে, কিছু একটা বোঝাতে চাইছে ভীষণভাবে আমাদেরকে। সমাজ ওকে মানসিক ভারসাম্যহীন আখ্যা দিলেও ও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ওর যে বোধটুকু অন্তত: আছে, আমরা সেটুকুও খুইয়ে বসে আছি - আজ আমরা বড়োরা ইমশ্ন্যালি-ইম্যুন্ড।

সামতিন দ্যাট ওয়জ টিয়্যারিন উইদিন, বাট কুড ন্যাট বি টর্ন য়্যাপার্ট।

একদিন আমারও তো এমনটাই মনে হত, টলস্টয়ের মেময়র্স অব আ ল্যুন্যাটিক না পড়েই, তবে কেন আজ পাগলিদিদিকে বড়ো হওয়ার উপদেশ দিতে ছুটে গেছি?

মোমের ওপর হাত রেখে অনুশীলন সমিতির সদস্য হওয়ার পরীক্ষা আমিও দিয়েছিলাম - কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারিনি।

তবু যতটুকু সময় ধরে চামড়া পুড়েছিল - তাতেই বুঝতে পেরেছিলাম সে পাগলামির মজা।

ব্যথা আনন্দ হয়ে যাচ্ছে আর আনন্দ ব্যথা, পেন আর প্লেজার সব মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, সে যণ্ত্রণাক্লিষ্ট আনন্দের অবসাদ-
খিন্নতার নেশা যে কি ভয়ঙ্কর - তবুও ভয়ঙ্কর সুন্দর তা।

সেকথা তোমার চেয়ে আর কে বেশি করে বুঝবে বলো তো রাই?

কবির এই স্কিজয়ড ভালোবাসার মূল্য কেউ দেবেনা কোনোদিন, আমিও পাইনি, তাই কি অমন করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেছি তোমার উপরে?

তার বদলা নিতে তুমি আমাকে ঘৃণা করো না রাই, আমার প্রাপ্যটুকুর সুদ সঞ্চয় করে যাও, আর একদিন তা উজার করে দাও মানবতাবিরোধীদের বিরূদ্ধে - নতুন কোনো এক কবিতার মাধ্যমে।

ভালোবাসা আর ঘৃণা…পেন্যান প্লেজার…প্রিরি স্ট্রেঞ্জ না?

ন্যুরোকেমিস্টরা বলেন দুটো সার্কিটের ক্লোজ প্রক্সিমিটি অনেক সময় একে অন্যটাকে ট্রিগার করে দেয় - কিন্তু এতে কি সব কথা বলা হয়ে যায়?

ঠিক যেন ছবির ভ্যানিশিঙ পয়েন্ট - যেখানে ট্রেন-লাইন দুটো মিশে গেছে।

চোখ খুলে যা দেখি সেটা কি সত্যি - নাকি চোখ বন্ধ করলেই রোজকার মায়ার খেলা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে?

নতুন করে আর মেইট্রিক্সের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

নাম-ভুলে-যাওয়া কোনো হলিউড ব্লকব্যাস্ট্যারে এক রিসার্চার একটি গোলাকার যানের মধ্যে বসে পড়েন। তারপর যখন সেটি পাক খেতে থাকে ক্রমশ:, এক সময় তিনি এক অজানা জায়গায় পৌঁছে যান, সেখানে তাঁর পরলোকগত বাবার দেখা পেয়ে যান তিনি। আবার আবর্তিত হতে থাকে যান, এক সময় থেমেও যায় তা, চোখ খুলে দেখেন এই পৃথিবীতেই বসে আছেন তিনি।

দ্য গেম ছবির নায়ক যখন ক্ল্যাইম্যাক্সে স্কাইস্ক্র্যাপার থেকে লাফ দেয়, নিচে পড়ে দেখে একটা ইন্ফ্লেটেড গালিচার ওপর শুয়ে আছে সে, সবটা শুধুই একটা খেলা ছিল মাত্র।

আরেকটি ছবিতে স্পেস-ক্যাপ্স্যুল শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে যায়, সেভাবেই তাকে প্রোগ্র্যাম করা হয়েছে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা ওভ্যার্র‌্যাইড করা যায়না। আর তার ভেতরে বসা পাঁচটি মানুষ, তাদের পাঁচটি সত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, কারণ সময় সেখানে স্থির। অসীম, অপ্রমেয়, অসঙ্গেয় - সে অনুভূতি।

কিন্তু কৃষ্ণ-বিবরের মধ্যে না বসে থেকেই, এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়েই সে অনুভূতির অংশীদার তো হয়েছিলাম এক সময়, তাই তার নেশা যেন দিন দিন তোমার ওপরে আরো বেশি করে চেপে বসছে - তাই না রাই?

গর্ভযণ্ত্রণা সে ব্যথার চেয়ে অনেক কম - আর শেষের তৃপ্তি প্রসবোত্তরের চেয়েও বেশি - মর্বিড-মধুর।

আজ নাহয় প্যাকেজ-ভ্রমণের মজা নিচ্ছি, কিন্তু একদিন তো পায়ে হেঁটেই দেখেছিলুম ফড়িং-দোয়েলদের, এত তাড়াতাড়ি কি করে ভুলে গেলাম সে ভ্যান্দাল্যুস্তের কথা - সে বোহেমিয় বন্যতা?

আজ আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে, তাই রাইয়ের মতো কোনো সংখ্যালঘুর গ্যার্ডিয়্যান সাজার চেষ্টা করেছি অগাধ জ্ঞানে, গুণীকে সোহাগের শাসনে বাঁধতে চেয়েছে জ্ঞানী!

যেসব সত্যিকে সুখের হিমঘরে চালান করে দিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলি আমরা, পাগলিটা সেসবই খালি টেনে বের করে আনে, আধুনিক সভ্যতার আলোকে যাদের বড়ো অসভ্য - খুব অশ্লীল দেখায়।

পাগলিটা খুবই খতরনাক, ওর প্রলাপ শুনলে খাঁচার পাখিরও আবার খোলা আকাশে ওড়বার সাধ জাগে, ব্র্যান্ডেড ব্ল্যাক চক্লেট ফেলে খেতে ইচ্ছে করে গ্রামবাঙলার বাদামতক্তি - আমার স্যনি-এরিক্সনের পলিফ্যনিক রিঙটোনে চাপা পড়ে যাওয়া মনের কথাগুলো আবার বুড়বুড়ি কেটে ওপরে উঠে আসতে চায়।

কিন্তু আমার মতো বড়োদের অদৃষ্টে বোধহয় শালীনতার সাজপোষাক আর ডিপ্ল্যমেসির ড্যনাটই লেখা আছে। তাই সে মারণবিদ্যে আমায় ছেড়ে চলে গেছে, তার সম্মান রাখতে পারিনি বলে, আমি সৌন্দর্য-তাণ্ত্রিক হতে পারিনি রে রাই।

গুণের কাছে জ্ঞান যে পরাজিত হবে সেতো নতুন কোনো কথা নয় - লাভ ইজ দ্য ট্র্যায়্যাম্ফ অব ইম্যাজিনেশ্ন ঔয়র ন্যলেজ।

ঘুরতে ঘুরতে ভালোবাসাব্লগে এসে মনে হয়, এর মাল্কিন বোধহয় সব কিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও, হয়ত মনের এক কোণে এটাকে এখনও বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন।

বিউটি ইজ দ্য প্রমিস অব হ্যাপিনেস - দেখি, শুধু দেখেই যাই, আমার নিজের আনন্দ ছোট পড়ে যায় তাঁর কাছে।

তাই নিজের ভালোবাসার কাঙালীপনা আর মনের ফুটো ঢাকতে ইচ্ছে করেই তাঁর কাছে করতে হয় উল্টোপাল্টা কমেন্টের ফুটুনি।

আমি এক সামান্য পদাতিক, আর যার অধীনস্থ সৈন্য, সেই সমস্ত বহুজাতিক রাজাদের যুদ্ধে - প্রায়ই প্রাণ হারাতে হয় এই সব উলুখাগড়াদের।

তাই, আজকে এই আবোল-তাবোলের অবতারণা, কে জানে - কাল হয়ত এসব বলার জন্যে বেঁচে থাকবো না।

কর্পরেট-কাল্চারের ম্যারিয়্যুয়্যান্যায় মগ্ন মৈথুনানন্দেরও সাধ হয় - ভালোবাসার আব্দার জানানোর অপরাধ করতে ইচ্ছে হয় দুটো চুড়ি-পরা হাত দেখে।

নগ্ন-নির্জন হাতের কথা মনে হয় না তা দেখে, অনেক দিন পরে আরো একবার নতুন করে ঢেউ ওঠে য়্যাফ্যারেন্ট-এফ্যারেন্ট স্নায়ুজালে, উদ্দীপিত হয়ে ওঠে তা কাব্য-কৌলীন্যহীন কিছু অনর্থক কথা-সঙ্কেতে।

রাজপথ থেকে গলিঘুঁজি
যৌথ ছেড়ে নিউক্লিয়স খুঁজি,
ল্যাপটপে মুখ ঢাকা
ভাইফোঁটা ভুলে থাকা;
সময়ের ম্যারাথন
স্তব্ধ করেছে সব…সম্পর্কের সামগান।
তবু আজ কেন মরা গাঙ
দিদি ডাকে বানভাসি,
শুনতে পাও - রাগ ইমন?


নগর-সভ্যতার এ অভিশাপ থেকে আমায় মুক্ত করার ক্ষমতা রাখে একমাত্র ঐ করপরশ, একথা জেনেও মনের কথা মনেই রয়ে যায়, আর মনের ভাব ঢাকতে বলতে হয় ফ্যাকাসে হাতের হোয়াইট-ব্যাল্যান্সের কথা।

জীবনের অঙ্কে যে শূন্য পেয়েছে তার কোনো যোগ্যতাই নেই ঐ হাতের ছোঁয়া পাওয়ার, তাই প্রতিদিনকার মেকি-আন্তরিকতার সোপ-অপেরায়, কালকে আবারও নিজের অভ্যস্থ হাত আরেক বার খুঁজে নেবে অনায়াস-অবহেলায় - পরিচিত শিশিতে রাখা পুরোনো গ্লিস্রিন।

করুণায় হোক কি কৃপায়, হোক না তা তাচ্ছিল্যের বেখেয়ালে, এক বারের জন্যে হলেও তিনি দেখিয়েছেন তো - যে সম্পর্কের সিলমোহর আমার পাগলিদিদির কাছ থেকে দেখার দূরাশা বাসা বেঁধেছিল মনে।

এখানে তো আরও অনেক মেয়ে ছিল, তবু এমন পাগলের মতো প্রেমে পড়তে গেলে যে আমার পাগলিদিদিকেই চাই, হয়ত একদিন পাগল ছিলাম বলেই আজ সেকথা মনে হচ্ছে।

কিন্তু আজ তো সে পাগলামির অভ্যেস কেটে গেছে - এখন দিদির তালে তাল মেলাবে কি করে এই ভাই?

কোথায় সে হলুদ পাখি…জামরুলগাছ…চালধোয়া ভিজে গন্ধ…তেপান্তরের মাঠ…বৃষ্টিতে এক-হাঁটু জল জমা সেই রাস্তাটা…সব হারিয়ে গেছে!

তবু আজ আমার এত আনন্দ লাগছে যে বলে বোঝাতে পারবো না কাউকে, বোঝার দরকারও নেই কারও, শুধু রাগ ইমন নামের কোনো প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট।

প্রায় এক যুগ পরে শুনলাম ভাই কথাটা, আমার পুংকিসোনা ডেকেছে, আর সেই জন্যেই তো লেখালেখির এই লোচ্চামি!

আর লেখালেখির ভন্ডামি করে লোক হাসিয়ে তো কোনো লাভ নেই - এ ছল তো শুধু হারানো সম্পর্কগুলোকে খুঁজে পাওয়ার লোভেই করা।

তৃষ্ণার্তকে মাত্র এক ফোঁটা আঙুরের রস দিয়েছে সে, খরার মাটি পেয়েছে এক বিন্দু বৃষ্টি, পুংকিসোনার একি দুষ্টুমি!

এখান থেকে চলেই যাবো, এখানে থাকলেই তো বারে বারে শুনতে লোভ হবে তোমার মুখ থেকে ভাই ডাক শোনার, কিন্তু তুমি তো পাগলি একটা - সব সময় নিজের খেয়ালখুশিতে চলো।

তোমার তিরিশে জুলাইয়ের জন্যে ঘাসফুল কোত্থেকে দেব আমি -টাকার গাছে ও ফুল ফোটে না।

তবে কোনো কিছু দিতে না পারি, একটা কথা দিচ্ছি তোমায়, সত্যিই মন থেকে - যে আজ থেকে রোজ পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও কার্টুন দেখবো।

কিন্তু…তুমি একটা দুষ্টু দিদি…পচা দিদি। ছোট্ট ভাইটাকে এমন করে কাঁদাতে আছে কখনো?

এই লাইনটা লেখার আগে কিছুক্ষণের জন্যে হাত সরিয়ে নিতে হয়েছিল ল্যাপটপ থেকে - আর চেপে রাখতে পারলাম না।

অনেক ক্ষণ থেকেই গলার মধ্যে এক দলা - কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল।

কিছুক্ষণের জন্যে আমি পুংকিসোনার চেয়েও বাচ্চা হয়ে গেছিলাম।

তাই সে বাচ্চাটার মুখ থেকেই না হয় দু-একটা কথা শোনো।

কাঁটাতারের ওপারে থাকা পুংকিদিদির জন্যে আমি কাঁদছি - এমনি এমনিই - বাচ্চারা যেমন কাঁদে - জোরে জোরে।

জীবনে মাত্র একবারই কেঁদেছিলুম, দশ বছর বয়সে, যখন বাবা মারা যান।

যে মেয়েটা শুধুমাত্র একবার ভাইয়া ডেকে, অচেনা কাউকে এমনভাবে নাকের জলে চোখের জলে করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সে কি করে মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে?

বিশ্বাস করো দিদি, ভালোবাসার যে সহজপাঠ তুমি আমায় শেখালে, আমাদের চারপাশে আরো অনেক নিরক্ষর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে - তাদেরও তোমায় বলে দিতে হবে, ঠিক কি করে উচ্চারণ করতে হয়, ঢাই আকশার প্রেম কে।

এই ভালোবাসা-ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে হবে সারা পৃথিবীতে, তাহলে হয়ত মরতে মরতেও বেঁচে যাবে মানুষগুলো, আবেগের-এডস হলে পরে।

দিদি…আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি নদীর পারে…তোমারই কাছে।

চোখ খুললেই মনে পড়ে যাবে সাগরকে দু-হাতের আঁজলায় বন্দী করার বোকামো।

এখনো আমি অন্ধ, তবে জ্ঞানে নয়, নদীমাতৃক মুগ্ধতায়।

চোখ বন্ধ করলেই সাগরটা নদী হয়ে যাবে - চোখ বুজেই নদীর ছবি এঁকে যাবো এবার থেকে।

দুকানে ভাইয়া ডাকের কলস্বন শুনতে শুনতেই নদীর জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করে যাবো।

মাঝে মাঝে দু-চার মিনিটের জন্যে উঠে গিয়ে নতুন বন্ধুদের খোঁজখবর নিয়ে আসবো।

তারপর আবার ফিরে এসে কাগজের নৌকা ভাসাবো নদীর বুকে।

প্রথম প্রথম সবগুলোই কিছুদূর গিয়ে ডুবে যাবে। ছোটবেলার সে অভ্যেস এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে না জানি।

কিন্তু - ঠিক একদিন!

যেদিন আমার নৌকা জলে না ডুবে মাঝদরিয়া অবধি চলে যাবে -মেঘবালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করব সেদিন।

রোদ্দুর…শুধু এক মুঠো রোদ্দুর…পেগ্যাস্যাসের পাখা-চুমা রোদ্দুর এসে পড়বে আমার চোখেমুখে।

স্বর্গের সে কবিতাকে আবার ছুঁড়ে দেবো নদীরই দিকে - আমার দিদির কাঁধ ছুঁয়ে সে কিছু বলবে।

পুংকিদিদি…এখন তো আমি বরাবরের মতো বাচ্চা হয়ে গেছি…এবার আমায় খেলতে নেবে তো?

মেঘমনা কন্যা


রক্তেরা বুক ঘষে
চলে ধীর-ধান্দায়,
এক মন দুই মণি
ভেসে যায় মিসিসিপি-বন্যায়।

পাঁশুটে এক নেকড়ে-ফিলিয়্যাক ভেতর-মড়া
ঘাইমৃগী-নাভিমূলে হিংস্রতা ঘোরাফেরা,
প্রস্ফুটিত সরলতা নিষ্পাপ-দ্বারে
অনাচারী মাতলামো লেখে বন্ধ্যা ইচ্ছেরা।

নব রভস অনুসন্ধানে, আম্লিক নিশ্বাস শুকিয়েছে
বিষিয়েছে বিশ্বাস, পঞ্চ-নদ-বাসন্তী-ভগ্ন -
চেনা মুখ ছিঁড়ে উঠে আসে
অচেনা মুখোশ সে নগ্ন।

খোলা চোখ নিদ-মন লুক্রেশিয়া-কন্যে।

ব্যাস, আর নয়, যোগীশিশু কেঁদে বলে
বিষণ্ণ দু:স্মৃতি যত মুছুক পূর্ণচ্ছেদে
ওগো পারুল রঙীন - জাগো সিন্ড্রেলা-স্বপ্নে।

সূর্যের সাত ঘোড়া
কিনেছি পার্সেক-কড়ি বিনিময়ে,
কৃষ্ণতা ঘুরে ঘরে ফেরা
অবোধ স্কন্ধ উদ্ভাসিত আলো-অণুরণনে।

পাগল ছেলে, বাড়ি ফিরে চল!
কানে টুসি, ফোটন কণার দল
পথ চেয়ে বসে আছে -
বৃষ্টির জল, ছেঁড়া ডুরে শাড়িরই আঁচল।

আজ থেকে আবারো - একইসাথে
সেই রংচটা পুরোনো দোলনায়,
গলাগলি খুনসুটি সব হবে
শৈশব-গন্ধ-মলিন সেই জীর্ণ নকশী-কাঁথায়।

কাগজ-ফুল


নেকড়ের শ্বাসে ভয়ে তরাসে
নীল হয়ে যাওয়া অই ঘাস-মেয়ে,
স্মৃতির কীটেরা বুকে ঢুকে ঘুরে ঘুরে
কুরে কুরে চলেছে যে খেয়ে।

আলাপিছে কাঁটাতার
বহু আগে বহু ভাবে,
একই রাগে বার বার
তুলসীতলে প্রদীপ ঘোরে যে উল্লাসে -
সেই চুপ-একা মন-কেমন সব সাঁঝে।

বাড়ি যা ন্যাকা ছেলে -
মরে গেছে তোর সব সোঁদা আব্দার!

লোভী চোখ চেটে গেছে শেষ ক'টা হাড়।
নগর-কপালে টোকা?
ধ্যাত বোকা!
অই মেঠো হাত তোরে খুঁজবে না আর।

সব জানি, সব বুঝি, তবু বলি
রাগ করেনা সোনামনি,
মুছে গাল খুকুমনি
ছুটে আয়, বুকে আয়।

দেরি হল, বেলা যায়
চুমো দিয়ে জ্বালা নেবো,
ওরে ফোকলা সোহাগ-নন্দিনী!

সম্পর্কের সেই সুতো পড়েনিকো বাঁজা হাতে
তবু তোরে ছুঁতে দিবি?
মুছে দেবো, ব্যথা দেবো না
দেখ দেখ - মোরা পাঁচ ভাই হয়েছি একসাথে।

কপাল-সেলেটে একবার কাটাকুটি খেলবি?
আমারই কোলেতে মুখ গুঁজে
থাক শুয়ে চুপ করে পাগলি।

ওপারেতে ভালোবেসে, এপারটা ভাসালি!
এই বড়ো হাঁদাটাকে শুধু শুধু কাঁদালি?
দেখ মা রে, ভালো করে
নখ নেই - থাবা না রে।

আজ থেকে হোক শুরু
আনকোরা খাসা খেলা,
নতুন স্বপ্ননেশা-মিষ্টি এই মিতালি।

আমারই কলজে কেটে - অফুরান
দিয়ে যাব তাজা রাঙা কালি।

লিখে যা রাশি রাশি
হেসে হেসে যত খুশি,
নতুন প্রেম-ভুলে-ভরা
এলোমেলো আধো-আধো আছে যত বুলি!